আপনি বিকাশ। প্রত্যন্ত এক গ্রামের শেষ প্রান্তে ততোধিক এক গরিবঘরে আপনার জন্ম। জন্ম থেকেই দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই। এ ভাবেই খুব কষ্টে কেটে গিয়েছে দীর্ঘ পঁচিশটা বছর। দু’ বেলা দু’ মুঠো খেয়ে কোনো রকমে বেঁচেবর্তে থাকাই আপনার লক্ষ্য।
গ্রামে আপনাদের একটি মাটির (কাঁচা) বাড়িও আছে। আর আছে চার কাঠা জমি। তাতে সামান্যই ফসল হয়, তাও বছরে এক বার। তাই গরিবের সংসারে সামান্য সুরাহা করার জন্য অন্যের জমিতে মজুরের কাজ করতে হয় আপনাকে।
আপনি তো জানেন আপনার কী অবস্থা! অথচ এই কাঁচা বাড়ি আর জমি দেখেই পাশের গ্রামের দিলীপকাকু তাঁর মেয়ের সঙ্গে আপনার বিয়ে দিয়ে দিলেন। আপনার মৃদু আপত্তি ধোপে টেকেনি। দায় বেড়েছে। কয়েক মাস পর আপনি বুঝতে শুরু করলেন, এই ভাবে বেশি দিন চলা সম্ভব নয়।
ও পাড়ার শিবুদা তো অন্য রাজ্যে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। বছরে দু’ বার গ্রামে ফেরেন। কত সুন্দর জামাকাপড় পরে আসেন, বাড়ির সকলের জন্য কত কিছু নিয়ে আসেন। এক বার শিবুদার সঙ্গে আপনার কথা হয়েছিল যখন গত বছর পুজোর ছুটিতে এসেছিলেন। কেমন একটা হাবভাব করছিলেন তিনি।
বউকে আপনি বলেছিলেন, কী ব্যাপার বলো তো?
বউ বলেছিল, ও সব ছাড়ো।
আমিও তো শিবুদাকে বলে ওঁর সঙ্গে অন্য রাজ্যে গিয়ে কাজ করতে পারি? আপনি বলেছিলেন। বউ সাফ মানা করে দেওয়ায় আপনার সে যাত্রা আর যাওয়া হয়নি।
কিন্তু ক্রমশ আপনার ওপর সংসারের চাপ বাড়ছিল। আর যতই চাপ বাড়ছিল, আপনি ততই শিবুদার সঙ্গে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠছিলেন। হাতে চাঁদ পেলেন আপনি, যখন পুজোর পর কালীপুজোতেও শিবুদা গ্রামে এলেন ৩-৪ দিনের জন্য।
আপনি ছুটেছিলেন শিবুদার সঙ্গে দেখা করার জন্য। আসলে শিবুদা গ্রামে এসেছিলেন আরও কয়েক জনকে যদি তাঁর জায়গায় নিয়ে যেতে পারেন, সেই আশায়। যেখানে শিবুদা কাজ করেন সেখানে বড়ো একটা বাড়ির কাজ শুরু হয়েছিল। ওই কাজ শেষের তাড়াও ছিল। আপনি শিবুদার কাছে যাওয়ায় শিবুদারও সুবিধে হল, আপনিও রাস্তা খুঁজে পেলেন। ভাইফোঁটা কাটতেই আগুপিছু কিছু না ভেবে আপনি শিবুদার সঙ্গে রওনা দিলেন ভিন রাজ্যে, দিল্লিতে।
নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ভালোই গেল। বাড়িতেও টাকা পাঠালেন। বাড়িতে ফোন করে জানলেন বউ খুশি। ভেবে রেখেছিলেন গ্রামে ফেরার সময় বউয়ের জন্য একটা সিল্কের শাড়ি কিনে ফিরবেন।
হঠাৎ ফেব্রুয়ারির গোড়া থেকেই একটা কানাঘুষো শুরু হল। এ দেশে ভিন দেশের প্রেসিডেন্ট আসবেন। কাজ সব বন্ধ থাকবে বেশ কিছু দিন। শিবুদা ভরসা দিলেন, চিন্তা করিস না। টাকা তো পাবি। শিবুদার ভরসার মাঝেও একটা ভয় ভয় কাজ করছিল।
তিনি এলেন ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে। তার পর কোনো রকমে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কাটল। তার পর একদিন শিবুদা বললেন, এ দেশে একটা রোগ এসেছে, নাম করোনা। কত রোগের নাম শুনেছেন, এ রোগের নাম তো কোনো দিন শোনেননি। ক্রমে কাজ কমতে শুরু করল। ইট, বালি, সিমেন্টও অমিল হতে শুরু করল। শিবুদার কপালে চিন্তার ভাঁজ। আপনিও ফ্যালফ্যাল করে শিবুদার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
হঠাৎ শিবুদা একদিন বললেন, বিকাশ লকডাউন শুরু হচ্ছে। লকডাউন? সে আবার কী? জানা গেল, এর অর্থ কাজ বন্ধ রেখে কিছু দিন চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে হবে। আপনি ভাবলেন, যাক কয়েকটা দিন বিশ্রাম নেওয়া যাবে। কিন্তু কিছু দিন পর শিবুদা আবার বললেন, লকডাউন বাড়ছে। এখন গ্রামে ফেরারও উপায় নেই। ট্রেন-বাস সব বন্ধ। আপনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। টাকাও আর হাতে নেই। চোখে জল এল। বউ আসতে বারণ করেছিল, কেন তখন শোনেননি। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, যে যেখানে আছেন, সেখানেই থাকবেন। ফ্রি খাবার দেওয়া হবে। দু’ বার খাবার দিয়েওছিল, তার পর আর কেউ খোঁজ নেয়নি।
হঠাৎ আপনি শিবুদার মুখে শুনলেন সরকার বলেছে, সবাইকে নিজের রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে টিকিট কাটার টাকা লাগবে। বেশ কয়েক দিন এক বেলা, এক মুঠো খেয়ে থাকা আপনার কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ চকচক করে উঠল। কিন্তু টাকা কোথায়? বউয়ের মুখটা ভেসে উঠল। শুয়ে শুয়ে আপনি আকাশ-পাতাল ভাবতে শুরু করলেন।
ভোট এলেই আপনার গ্রামের মাটির ওই কাঁচা বাড়িতে অনেক রাজনৈতিক নেতার আনাগোনা বেড়ে যায়। প্রয়োজনে মাথা নিচু করেই বারান্দায় পাতা খেজুরপাতার চাটাইয়ে বসতে একটুও দ্বিধা করেন না তাঁরা। আপনার পরিবারের হাতের এক গ্লাস জল যেন ওই নেতাদের জীবন ফিরিয়ে দেয়। আপনার নোংরা জামা পরা শিশুটিকে তাঁরা কত্তো ভালোবাসেন। এক পলকে তাকে কোলে তুলে নিতে একটুও আড়ষ্টতা নেই। পারলে এক মুহূর্তে তাঁরা আপনার পৃথিবীটা বদলে দিতে পারেন। এ সব দেখে আপনিও গলে জল হয়ে যান।
কারণ আপনি একজন ভোটার। ভোটের সময়ই আপনার বিশাল গুরুত্ব। মনে মনে আপনার ভালোই লাগে। হয়তো তুল্যমূল্য বিচার করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেন – না, উনিই সব চেয়ে বেশি ভাবেন আমার মতো সাধারণের জন্য। আমারও তো ভোটটা ওঁকেই দেওয়া উচিত। বিশ্বাস করুন, সেই মুহূর্তে নেতাকে ঘিরে থাকা সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরার ঝলকানিতে সত্যি আপনার চোখ ঝলসে্ যায়।
আর আপনি আজ যখন নিজের পেটের তাগিদে, বলতে পারেন পেটের জ্বালায়, ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন, তখন সেখান থেকেই নিজে একবেলা খেয়ে সংসারের জন্য টাকা পাঠিয়েছেন। কেউ পাশে দাঁড়াননি। কেন গিয়েছিলেন? কেউ জানতে চাইবে না কোনো দিনও।
যখন ভিন রাজ্যে করোনার থাবায় আটকে আছেন, যখন আপনার এক বেলা খাওয়ার টাকাও হাতে নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁইও সেই রাজ্য আপনার থেকে কেড়ে নিয়েছে, আতংকে কাটছে আপনার প্রতিটি মুহূর্ত, নিজের ঘরে ফেরার জন্য আপনি উদগ্রীব আর সেই সময় আপনি সম্পূর্ণ কপর্দকশূন্য। এই ভাবে প্রায় চল্লিশ দিন কেটে যাওয়ার পর আপনার দেশের প্রশাসন একটু সদয় হয়ে আপনাকে ফেরানোর উদ্যোগ নিল, যারা আপনার ভোট পেয়ে আজ ক্ষমতায়। শুধু ট্রেনের ভাড়া নয়, স্লিপার ক্লাসে আসতে গেলেও অতিরিক্ত ৫০ টাকা আপনাকে গুনতে হবে। টাকা আপনার কাছে নেই, তো কী করবেন আপনি?
মনে মনে ভাবছেন, এই আমার দেশ! এই দেশের জন্য ভোট দিই! এই দেশকে আমরা ট্যাক্স দিই, যেখানে সাধারণের কথা ভাবাই হয় না?
আপনি হয়তো আপনার রাজ্যে ফিরবেন, তবু ফেলে আসা চল্লিশটা দিনের কথা ভুলে যাবেন। আবার পরবর্তী ভোটের আগে তাঁদের কাউকে না কাউকে দেখতে পাবেন। আর আবার সেই ব্যাপারগুলোই ঘটবে। আর আপনিও সেই ভুলটাই আবার করবেন।
লেখক:স্পন্দন গাইন, প্রধান সম্পাদক, গ্লোব টেলিভিশন, কলকাতা