ঢাকা: বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে দেশের সব সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অফিস বুধবার সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়েছে। রাজধানীর (dhaka) সড়কে গণপরিবহনের সংখ্যা কম থাকায় প্রথম দিন বুধবার সকাল থেকেই চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন অফিসগামী যাত্রীরা।
বিশেষ করে বিপাকে পড়েছেন নারীরা। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর গাড়ি না পেয়ে অনেকে হেঁটে কর্মস্থলে গেছেন। তবে নিয়ম মেনে সকাল ৮টায় উপস্থিত হয়েছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সচিবালয় প্রাঙ্গণে আগের মতোই রাখা ছিলো সারিসারি গাড়ি। সকাল ৮টার মধ্যেই প্রাণোচ্ছল ফিরে পায় সচিবালয়।
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় বুধবার সকাল ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত অবস্থান করে দেখা যায়, নতুন সময়ে অফিস ধরতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যক্তিগত গাড়ি, স্টাফ বাস ও মোটরসাইকেলে যাচ্ছেন।
বুধবার সকালে সড়কে বেসরকারি বাস পর্যাপ্ত দেখা যায়নি। যে বাস ছিল, তার প্রায় প্রতিটিতে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে অফিসে গেছেন। বাসে নারীদেরও দাঁড়িয়ে যেতে দেখা গেছে। বাসের জন্য অনেক সময় অপেক্ষা করতে দেখা গেছে অফিসগামী শত শত যাত্রীকে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে বাস পেতেও সমস্যায় পড়তে হয়েছে অনেককে।
ঘুম থেকে ঠিক সময়ে উঠতে না পারাসহ নানা কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ কেউ অফিসের বাস পাননি বলে জানিয়েছেন। ফার্মগেটে এমন একজন সরকারি কর্মজীবী বলেন, বাস মিস করেছি। এখন কথা বলার মুড নাই।
এছাড়াও সাধারণ মানুষও বাস না পেয়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। ষাটোর্ধ্ব আমিনুল হক ভূইয়া স্ত্রীকে নিয়ে ফার্মগেটে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি বলেন, বারডেম হাসপাতালে যাওয়ার জন্য প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি।
কিন্তু কোনো বাসে উঠতেই পারছি না।
আদালতও বুধবার সকাল আটটায় খুলছে। ফলে, আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাও সকালে বের হয়েছেন। মো. টিকে আজাদ নামের এক আইনজীবী বলেন, আজ (বুধবার) মনে হচ্ছে বাস অনেক কম। ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি। বাসের দেখা নেই।
গতকাল বুধবার সকাল ৭টায় খিলক্ষেত বাসস্ট্যান্ডে সরেজমিনে দেখা যায়, অফিসগামী যাত্রীরা গাড়ির জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন।
কিন্তু গাড়ির দেখা মিলছে একেবারে কম। এসব গাড়িতে উঠতে যাত্রীদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে। তবে হুড়োহুড়ি করে বাসে ওঠতে না পেরে বয়স্ক ও নারী-শিশুদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে দীর্ঘক্ষণ। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সমন্বয়হীনতার কারণে এমনটা দেখা গেছে।
বেসরকারি চাকরিজীবী মনোয়ার হোসেন থাকেন রাজধানীর খিলক্ষেতে। তার অফিস ফার্মগেট এলাকায়। সকাল ৮টায় তার অফিস, বাসা থেকে বের হয়েছে সকাল ৭টায়। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর গাড়িতে উঠতে সমর্থ হন তিনি। তার মতো ক্ষোভপ্রকাশ করে অন্য যাত্রীরা বলছেন, পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কোনো আলাপ না করে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মনে হচ্ছে।
সেজন্য সকালে পরিবহন সংকট তৈরি হয়েছে। এতে জনসাধারণই ভুগছেন। অথচ আগে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বললে এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না। অনেকই আবার সকালে অফিস হওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ধীরে ধীরে এই সংকটের সমাধান হয়ে যাবে।
এদিকে সচিবালয় ঘুরে দেখা গেছে, নতুন নিয়ম মেনেই সকাল ৮টায় অফিসে এসেছেন অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী। মন্ত্রণালয়গুলোতে উপস্থিতিও ছিল ভালো। সকালে অফিসে এসে অনেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও সমস্যার কথা বলছেন নারীরা। তবে ধীরে ধীরে মানিয়ে নেওয়া যাবে বলেও মনে করছেন তারা। অনেকেই বাচ্চা নিয়ে সচিবালয়ে এসেছেন। সচিবালয় প্রাঙ্গণে আগের মতোই রাখা আছে সারিসারি গাড়ি।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের শারমিন আক্তার জেবা বলেন, আমাদের অফিস টাইমটা সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা করলে ভালো হতো। সকাল সকাল বাচ্চাদের স্কুলে নেওয়া, খাওয়া দাওয়া করানো কষ্টকর হয়ে গেছে। যেহেতু সরকারের নির্ধারিত নিয়ম, তাই সেভাবেই চলতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নাজমুন নাহার বলেন, আজকে (বুধবার) নতুন নিয়মে অফিস শুরু হলো।
কিছুটা সমস্যা হয়েছে যেহেতু প্রথম দিন। উঠতে কিছুটা দেরি হয়েছে। বাচ্চাদের রেডি করে আসতে পারিনি। কাজের মেয়ের উপর ভরসা করে চলে আসতে হয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। এটা মানিয়ে নিতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা রওশন আরা বেগম বলেন, বুধবার থেকে অফিসের সময় এগিয়ে গেছে, কিছুটা সমস্যা হয়েছে প্রথম দিনে। কিন্তু আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। সবকিছুই তো অভ্যাসের ব্যাপার।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মরত রোকসানা আক্তার বলেন, প্রথম প্রথম সকাল ৮টায় একটু সমস্যা হলেও ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে পারব। বিকেলে আবার ৩টায় অফিস শেষ। সেজন্য দিনের শেষে ভালো একটা সময় পাব, এটা ভালো দিক।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থা। সাধারণত সপ্তাহে কর্মঘণ্টা হয় ৩০ থেকে ৩৫ ঘণ্টা। এতে কিছুটা টান পড়লো।
জ্বালানি-বিদ্যুতের চলমান সমস্যা অস্বীকার করে তো আপনি এখন কোনো পরিকল্পনা করতে পারবেন না। এই সমস্যা দূরীকরণে বা সামলে নিতে নানান পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। তারই অংশ হিসেবে কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা। শহরের ট্রাফিক জ্যাম জ্বালানির ওপর প্রভাব ফেলবে। কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত খারাপ মনে করছি না। তিনি আরো বলেন, আসলে একই ধারায় সব সময় পৃথিবী চলে না।
মহামারির জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু আমাদের মোকাবিলা করতে হলো। মানুষের জীবন-মানের পরিবর্তন এলো। সামনে হয়তো আরো অনেক কিছুই অপেক্ষা করছে। ভালো সময় যাচ্ছে না, তা অন্তত বলতেই পারি। তবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমাদের আরো দায়িত্বশীল ও সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে আমাদের উৎপাদনের দিকে আরো নজর দিতে। খাদ্য নিরাপত্তায় জোর দিতে হবে। কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনলে অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বেই।
কিন্তু তা পুষিয়ে নিতে আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিশ্ববাজারে আমাদের উপস্থিতি আরো বাড়াতে হবে। ধরতে হবে নতুন বাজার।
গত সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
স্বাভাবিক সময়ে সরকারি অফিস সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলোতে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত লেনদেন আর লেনদেন পরবর্তী আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো ৬টা পর্যন্ত।
গত সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। শুক্রবার ও শনিবার-সাপ্তাহিক ছুটি। প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়, জরুরি পরিষেবাসমূহ নতুন অফিস সময়সূচির আওতাবহির্ভূত থাকবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সময়সূচি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/ বিভাগ নির্ধারণ করবে। এতে আরো বলা হয়, ব্যাংক, বিমা, অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক সময়সূচি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। উল্লেখ্য, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছিলেন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনাকে কীভাবে আরো ইফেক্টিভ করা যায় এই মুহূর্তে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ইনস্ট্যান্টলি তো বাড়ানো সম্ভব হবে না। সে জন্য আলোচনা হয়েছে কতগুলো। তিনি বলেন, আগামী ২৪ আগস্ট থেকে সব সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত অফিস, সরকারের অধীনে যেসব অফিস আছে সেগুলো সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত হবে। বেসরকারি অফিসের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলেও জানিয়েছেন তিনি।