যে বন্দরের জেটিতে সবসময় পণ্যবাহী জাহাজ থাকতো, থাকতো পণ্য ওঠানামার প্রচন্ড ব্যস্ততা, সেখানে এখন নেই কোন জাহাজ, নেই কোন ব্যস্ততা। এ যেন এক ভিন্ন চিত্র চট্টগ্রাম বন্দরের।প্রলয়ঙ্করী ঘূর্নিঝড় আম্ফানের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি থেকে জাহাজগুলোকে ইতিমধ্যেই গভীর বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে বন্দরের জেটিগুলো এখন জাহাজশূণ্য অবস্থায় ।এই হচ্ছে অঅজ ২০ মে এবং গত ১৯ মে চট্টগ্রাম বন্দরের চিত্র।এদিকে ঘূর্নিঝড় আম্পান’ এর প্রভাব, এরপর ঈদের বন্ধ, বন্দরে স্তুপ হওয়া কন্টেইনার ও বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোগুলোতেও কন্টেইনার জট হওয়াতে চট্টগ্রাম বন্দর আবারো ‘অটো লকডাউন’ হয়ে যাওয়ার বড় ধরনের শংকায় রয়েছে। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট সংকটের কারনেই চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানী-রপ্তানী কার্যক্রম চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রধানতম সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরসহ অন্যান্য বন্দরে ঘূর্নিঝড়ের প্রভাবে স্বাভাবিকভাবেই পন্য ওঠানামার কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে গত মঙ্গলবার(১৯ মে) থেকে। বন্দরের জেটি এখন জাহাজশূণ্য। এমনিতেই গত রবিবার(১৭ মে) থেকে বহি:নাঙ্গরে অবস্থানরত বড় জাহাজগুলো থেকে লাইটারেজ ভ্যাসেলে ( ছোট জাহাজ) পন্য খালাস বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে গত মঙ্গলবার থেকেই আর কোন পন্য ওঠানামার কাজ হচ্ছেনা। আর ঘূর্নিঝড়ের প্রভার কাটিয়ে ঠিক কবে নাগাদ আবার জাহাগুলো ফিরে আসতে পারবে বন্দরের জেটিতে এবং পন্য ওঠানামার কাজ শুরু হবে তাও অনিশ্চিত। আর এর পরেই ঈদের ছুটি শুরু হবে । সেক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরে এ মাসের শেষ পর্যন্ত একটি বড় ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে বলে বন্দর সংশ্লিষ্টরা আশংকা প্রকাশ করছেন।
বন্দর কর্তৃপক্ষ করোনা দূর্যোগের ক্রান্তিকালে ব্যবসায়ী ও জাতীয় স্বার্থে বন্দর থেকে কন্টেইনারবাহী নানা ধরনের পন্য খালাসের সুযোগ দিলেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি আমদানীকারকরা সে তুলনায় তাদের কন্টেইনার খালাস না করাতে। গত মঙ্গলবারও চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে প্রায় ৪৭ হাজার টিইইউএস ( ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনার একক হিসেবে) কন্টেইনারের স্তুপ জমা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বন্দরের সচিব মো: ওমর ফারুক।
বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেছেন, বহি:নোঙ্গরে অবস্থানরত বড় জাহাজগুলোকে কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন্স ও টেকনাফের দিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ছোট ছোট লাইটার জাহাজগুলোকে কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতুর উজানে চলে গেছে আরো আগেই। কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিনসহ কক্সবাজারে গভীর সাগরে এখন জাহাজ রয়েছে ৮০ টিরর বেশি। ঘুর্নিঝড় ‘ আম্পান’ এর সম্ভাব্য আঘাত থেকে রক্ষার জন্য কারনে এসব জাহাজকে সার্বক্ষণিক ইঞ্জিন সচল রেখে এবং গভীর সাগরে নিরাপদ অবস্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সোমবার (১৮ মে) বিকেলেই আবহাওয়া অধিদফতরের ৬ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেতের ভিত্তিতে ‘অ্যালার্ট -৩’ জারি করেছে। ২০ মে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য ৯ নম্বর বিপদ সংকেত ঘোষনার পরই চট্টগ্রাম বন্দর তাদের নিজস্ব ‘অ্যালার্ট-৪’ জারী করেছে।বন্দরের নিজস্ব এই সংকেত (‘অ্যালার্ট -৩’) জারির পর পরই বন্দরের অপারেশনাল কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়ার নিয়ম রয়েছে।
শিপিং এজেন্ট, বন্দর ব্যবহারকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বন্দর কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অনেক আমদানীকারক বন্দরের ইয়ার্ডকে অনেকটা গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন। বাজারে পণ্যের দাম কমলে তারা কনটেইনার ডেলিভারি নেন না। আবার কনটেইনার জটের কথা বলে পণ্যের দাম বাড়িয়েও দেন অনেকে। প্রসঙ্গত: করোনা সংকটের কালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ,বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় ও সংস্থা দেশে বিশেষ করে রেফার কন্টেইনারে আসা পন্যগুলোর দ্রুত খালাসের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি সব ধরনের পন্য বোঝাই কন্টেইনার যাতে বিভিন্ন বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে সরবরাহ করে বন্দরের ইয়ার্ডে কন্টেইনার জট কমানো যায় সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এমনকি এজন্য বার বার বিভিন্ন মেয়াদে বন্দরের ইয়ার্ডে অবস্থানকালীন ভাড়াও মওকুফ করে দিয়েছে। এই সুযোগ অঅগামী ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তারপরও বেশ কিছু আমদানীকারক এসব কন্টেইনার বন্দর থেকে খালাস করাচ্ছেন না।
অপরদিকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করা অতিরিক্ত শিপিং ডেমারেজ ফেরত দিতে শিপিং এজেন্টগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে নৌ পরিবহন অধিদপ্তর। একই সাথে আগামী ৩০ মে পর্যন্ত আদায় না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত ১৭ মে রবিবার ঢাকায় অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন , ২৬ মার্চ থেকে সরকারি ছুটি চলছে। তাই ডেমারেজ আদায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শিপিং এজেন্টগুলো তা মানছিল না। তাই গতকাল সব ব্যবসায়ী পক্ষকে নিয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। ২৮ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ডেমারেজ আদায় করতে পারবে না এবং এই সময়ের মধ্যে ডেমারেজ নিয়ে থাকলে তা ফেরত দিতে হবে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাস এসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন এ ব্যাপারে বলেন, ‘রেফার কন্ইেনারের পণ্যগুলো যাতে দ্রুত ও সঠিক সময়ে ডেলিভারি করা যায় দেশের এই সংকটকালীন সময়ে সেজন্য আমদানীকারক, কাষ্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সবাইকেই সহনশীল ও কিছুটা উদার হওয়া প্রয়োজন। তবে শুধু রেফার কন্টেইনার নয় অন্যান্য পন্যবাহী কন্টেইনারও বন্দরের ইয়ার্ড থেকে দ্রুত সরানোর কার্যকর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে দেশ যেমন রাজস্ব হারাবে, তেমনি সাধারন ভোক্তারা এসব পণ্য সঠিক সময়ে এবং সঠিক দামে কিনতে পারবেন না, আবার শিপিং ব্যবসায়ীসহ আমদানীকারকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
—সমরেশ বৈদ্য, চট্টগ্রাম(বাংলাদেশ)।