অসম

শহীদ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা ৮৫৫ বীরের চরণেঃ অসম আন্দোলনে প্রাণাহুতি দেয়া ১৪ বীর বাঙালিকে কী আমরা বাংলাভাষা বিদ্বেষভাবে ভুলে থাকবো?

১০ ডিসেম্বর, শহীদ দিবস। অসম আন্দোলনের প্রথম বীরশহীদ বরপেটা জেলার ভবানীপুর সমষ্টির অন্তর্গত উজান বরবড়ি গ্রামের খর্গেশ্বর তালুকদার।

১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত চলা অসম আন্দোলনের সময় মোট ৮৫৫ জন বীর প্রাণাহুতি দিয়েছিলেন। এবং খর্গেশ্বর তালুকদারের শহীদ হওয়া দিনটিকেই শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

অসমে এনআরসি এবং ক্যাব তথা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের নামে যে বাঙালিবিদ্বেষ ফের চাগাড় দিয়ে উঠেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক।

অসম আন্দোলনে আত্মাহুতি দেয়া ৮৫৫ জন শহীদের কথা বারংবার উচ্চারিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সে শহীদের ত্যাগ, বলিদান, শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।

কিন্তু অসমের একাংশ বাংলা ভাষা বললেই একটি ভাষিক বিপন্নতা অনুভব করেন। মাত্রাতিরিক্ত আবেগে অবিশ্বাস্যভাবে ভুল বার্তা প্রদান করা হচ্ছে চারদিকে।

কিন্তু এই অসম আন্দোলনে ৮৫৫ জন শহীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ১৪ জন বাঙালি (হিন্দু বাংলাভাষী)।

সে তথ্য নিশ্চয়ই কারোরই অজানা নয়।

সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে অজ্ঞতাবশে একাংশ জনগণ বাঙালির বিরুদ্ধে সুর পঞ্চমে তুলে চিৎকার করছে বাঙালিকে পেটানো উচিৎ, বাঙালিকে ছিঁড়ে ফেলা উচিৎ।

এমন মুর্খ-অশিক্ষিত-গোঁড়া যুবকেরা কি অস্বীকার করে যাবেন শহীদের তালিকা থেকে ১৪ জন বাঙালি শহীদের নাম?

কি বার্তা দেবে এই যুবসমাজ আগামি প্রজন্মকে? বাঙালির বিরুদ্ধে বিষবাষ্প প্রবেশ করিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে তাঁরা কী অপমান করছে না শহীদদের?

অসম আন্দোলনের ৮৫৫ জন শহীদের তালিকায় থাকা বাঙালি বীর শহীদদের মধ্যে কারা কারা ছিলেন, তালিকা নিম্নে দেয়া হলোঃ

১- মৃণাল ভৌমিক> শিমলুগুড়ি, কামপুর
২-অনিল সরকার> হোজাই
৩-আশুতোষ দেবনাথ>চৌতারা, কোকরাঝাড়
৪-মদন মল্লিক> ডালিমবাড়ি, কার্বি আংলং
৫-পূর্ণ বিশ্বাস>নুনমাটি, হাতিপোটা, ধুবড়ি
৬-দীনেশ মণ্ডল> চাঙেগাঁও, পুঠিমারি, কার্বিআংলং
৭-শ্যাম কুণ্ডু> জামুগুড়িহাট, শোণিতপুর
৮-শম্ভু পাল> পচতিয়া, মরিগাঁও
৯-মহানন্দ সরকার> গহপুর
১০-বেলোবালা বিশ্বাস> অভয়াপুরি
১১-পরীক্ষিত মণ্ডল>জাগিরোড
১২-মহিল মণ্ডল>জাগিরোড
১৩-বিষাদু নমশূদ্র>ধুবড়ি
১৪-জলরাম সূত্রধর>বঙ্গাইগাঁও

শহীদের জাত নেই, ধর্ম নেই। তাঁরা শহীদ। তাঁরা কেবল শহীদ। তাঁরা শহীদ মানুষের জন্যে। মানবতার জন্যে। তাঁরা অসমিয়া নন, বাঙালি নন। তাঁরা মানবতাবাদী। অখণ্ডতার প্রতীক।

শুধু তাই নয়, আমরা চলে যাবো ১৯৫৯থেকে ১৯৬০ সাল, সারা অসম ছাত্র সংস্থার হালের দিকে।

সারা অসম ছাত্র সংস্থার প্রথম সভাপতি ছিলেন বাংলাভাষী বিমান কর।

বাঙালি বলতেই এক ভাষিক বিপন্নতা অনুভব করে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গ কিংবা বরাক উপত্যকাতেও বাঙালিদের মাঝে অসমিয়া বিদ্বেষ শিকড় ছড়িয়েছে।

এই বিদ্বেষের শিকড় কিন্তু ছড়িয়ে রয়েছে সরাসরিভাবে ১৮৩৬ সাল থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত অসমে ব্রিটিশ সরকারের বাংলা ভাষা রূপায়নের ঘটনায়।

অধিকাংশ নষ্ট পণ্ডিতের অসমে বাংলা ভাষার আগ্রাসন, অসমিয়া ভাষা বিলুপ্ত প্রভৃতি বার্তায় বিষের শেকড় ছড়িয়ে পড়েছে।

অথচ আমরা যদি মুক্ত দৃষ্টি দিয়ে চারপাশে একটু চোখ মেলি, তাহলে দেখব অসমিয়া পণ্ডিতরাই কিন্তু সর্বান্তকরণে স্বীকার করছেনঃ

“বলতে গেলে ব্রিটিশ আসার পূর্বে অসমে অসমিয়া এবং বাঙালি মিলনের গঙ্গা-যমুনা স্রোত বয়ে বয়ে গিয়েছিল।”

উনিশ শতকে অসমে বাংলা ভাষা প্রচলন করার অন্তরালে যে বাঙালি আমলার হাত ছিল তার প্রমাণ কোথাও মেলে না। শুধুমাত্র সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে অসমে বাঙালিদের, বাংলা বাষাভাষাভাষী লোকেদের কোণঠাসা করে অহেতুক বিদ্বেষী চোখে দেখে জীবন বিপন্ন করে তোলা হচ্ছে।

জেনকিনসন স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ

“অসমে বাংলা ভাষা চালানোর পরামর্শ দেওয়ার মূলে আমি। আমি বাংলা পক্ষপাতী। আমার আদেশ রবিনসন পালন করছে। অসমীয়া ভাষাকে শিক্ষার বাহন করতে হলে দেশের অধঃপতন হবে।”

তৎকালীন সময়ের ব্রিটিশ প্রশাসনের মুখ্য ব্যক্তিদের মন্তব্য থেকে একথা সুষ্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, ইংরেজ আধিকারিকদের নির্দেশমর্মে অসমে বাংলা ভাষা প্রচলন হয়েছিল।

কাজ-কর্ম-চরিত্রের দ্বারা মাতৃসংস্কৃতি-মাতৃভাষা রক্ষা পায়। কেবলমাত্র মায়ের মুখের ভাষা মাতৃভাষা নয়।

বাঙালি-অসমিয়ার সম্পর্ক বড় মধুর। আমরা কেন অজ্ঞাত-মুর্খকে মাঝখানে দাঁড় করিয়ে এই সম্পর্ক নষ্ট করতে চলেছি?

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট ৩ বার অসম ভ্রমণে এসেছিলেন। শুধু তাই নয় কবিগুরুর পরিবারের সঙ্গে অসমিয়া সমাজের অত্যন্ত মধুর এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল।

অধ্যক্ষ জ্ঞানদাভিরাম বড়ুয়া ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র অরুণেন্দ্রনাথের কন্যা লতিকা দেবীর স্বামী।

এছাড়া, অসমের বিখ্যাত বেজবরুয়া পরিবারের রসরাজ লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার সঙ্গে কবির ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর বিয়ে হয়েছিল।

ঠাকুর পরিবারের এই দুই জামাতার পাশাপাশি ওই পরিবারের বধু হয়েছিলেন একজন অসমিয়া মহিলা। তিনি বিখ্যাত অসমিয়া সাময়িক সাময়িক পত্রিকা ‘আবাহন’এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ডঃ দীননাথ শর্মার কন্যা তথা সংগীতশিল্পী দিলীপ শর্মার বোন আরতি শর্মা ঠাকুর।

অসমের জনজীবনে বিশ্বকবি তাঁর অভ্রভেদি মহত্ত্ব নিয়ে আজও প্রতিষ্ঠিত।

অসম ফের ক্রান্তিকালের সৃষ্টি হয়েছে ভাষা নিয়ে। ভাষাগত আবেগ যেন ফের অসমকে আগুনে ছাই করে না ফেলে সেটাই একান্তভাবে কাম্য।

অসমের মূল সংযোগী ভাষা অসমিয়া। একদিকে বাঙালির মাতৃভাষা এবং অপরদিকে ধাত্রীভাষা অসমিয়াকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করার পাশাপাশি অসমিয়াভাষীদেরও অহেতুক বাংলা ভাষা বিদ্বেষ ত্যাগ করা উচিৎ। অসমের জাতীয় জীবনে বাঙালির অবদান অনস্বীকার্য।

নর্থ ইস্ট নাও’য়ের পক্ষ থেকে ৮৫৫ শহীদের উদ্দেশে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

সাগরিকা দাস

Recent Posts

বাংলাদেশে হিটস্ট্রোকে উপজেলা মহিলা ভাইসচেয়ারম্যান প্রার্থীসহ  ৪ মৃত্যু, স্থগিত নির্বাচন

ঢাকা: বাংলাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে অতি গরমের ফলে হিটস্ট্রোকে ৩৭ জন মারা গিয়েছেন।…

1 week ago

বাংলাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহে রেললাইন বেঁকে ট্রেন চলাচল বিঘ্ন

ঢাকা: বাংলাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহে রেললাইন বেঁকে ট্রেন চলাচল বিঘ্ন ঘটছে। যাকে রেলের ভাষায় বলা হয়…

1 week ago

সাপ্তাহিক রাশিফল

মেষ রাশির জাতক জাতিকাদের জন্য সপ্তাহটি ভালোই হতে চলেছে। অর্থ উপার্জন হবে। সমাজে সম্মান বাড়বে।…

1 week ago

বাংলাদেশে তাপদাহে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুনঈশ্বরদীতে রেললাইনের পাত বেঁকে গেছে

ঢাকা: বাংলাদেশে চলতি বছর সীমাহীন তাপদাহে মানুষের জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশে সরবোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে…

2 weeks ago

আপনার আজকের দিনটি

সিংহ: আজকের দিনটি আপনার জন্য নতুন কিছু শেখার দিন হবে। ভাগ্যের দিক থেকে দিনটি ভালোই।…

2 weeks ago

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত

ঢাকা: বাংলাদেশে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে আবুল কালাম (২৫)…

2 weeks ago