কলকাতা: আম্বানি বাড়ির ছোট ছেলের বিয়ে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল ঝড়। এই ঝড়ে ফেসবুকে প্রবেশ করা দায়। বাংলাদেশের জনগণ তো দেখা যাচ্ছে এই বিষয়টি নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে।
এবার মুখ খুললেন তথাগত রায়:
“দিন কতক ধরে বাংলার সোশাল মিডিয়া সরগরম শিল্পপতি আম্বানি বাড়ির ছোট ছেলের প্রিওয়েডিং ধামাকা নিয়ে। বেশির ভাগই নেগেটিভ পোস্ট। পাত্রের চেহারা নিয়ে রঙ্গরসিকতা… পাত্রী আসলে গোল্ড ডিগার… বম্বের ফিলিম স্টারদের আদিখ্যেতা… বিয়ে বাড়িতে পারফরম্যান্সের সময় জগৎ বিখ্যাত পপ স্টারের জামা ছিঁড়ে যাওয়া… বিপুল অপচয়… অনুষ্ঠানের মধ্যে জয় শ্রীরাম বলা, কৃষ্ণনাম নেওয়া…ওই টাকায় কটা ইশকুল হত, কজন গরীব বড়লোক হয়ে যেত… ইত্যাদি ইত্যাদি।
কেউ কেউ আবার দেড় হাত রচনা লিখছেন – পরিবারটি কত বড় চোর। পঞ্চাশ বছর ধরে শুধু চুরি করে এই টাকা কমিয়েছে।
কিন্তু একবারও সঙ্গে এই হিসেবটা দেখলাম না – কত জন বাঙালি রিলায়েন্সে চাকরি করেন। তাহলে বাংলার কত জনের ঘরে সেই চুরির টাকা ঢুকছে, সেটাও আন্দাজ পাওয়া যেত।
কিম্বা, নিজেদের ছেলেপুলের বিয়েতে সঙ্গীত, মেহেন্দি, উদ্ভট প্রিওয়েডিং ফটোশুট ইত্যাদি করে মধ্যবিত্ত বাঙালি যে দেদার টাকা ওড়ায়, সেখানে গিয়ে ফেলে ছড়িয়ে নেমন্তন্ন খেয়ে কখনো মনে হয় – এই টাকায় কতগুলো গরীবের পেট ভরতো?
আরও কিছু জরুরি বিষয় নিয়ে তেমন আলোচনা হল না, যেমন – উন্নাসিক বাঙ্গালীর মতে অশিক্ষিত এই ব্যবসায়ীটি পয়সার জোরে ফিলিমস্টার টার এনে যে অনুষ্ঠানে দেদার ফুর্তিফার্তা করেছে, সেই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন – মার্ক জুকাবার্গ, বিল গেটস সমেত পৃথিবীর বেশ কিছু প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ীকুলও। যাঁদের ফালতু নষ্ট করার মত টাইম নেই, তবুও তাঁরা দিব্যি এক বাঙালি মতে অশিক্ষিত, ডাকাত ব্যবসায়ীর ছেলের প্রিওয়েডিংয়ে ফুর্তি করে গেলেন।
একবারও মনে হল না, ফিল্মের লোকেরা হয়তো প্রচার বা পয়সার লোভে এসেছেন, কিন্তু সুন্দর পিচাইরা এই নটোরিয়াস চোরেদের উৎসবে এসে সময় আর সুনাম নষ্ট করলেন কেন?
কারণ হল – বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। ওঁরা নিজেদের গুরুত্ব সারা পৃথিবীর সামনে প্রমাণ করেছে অনেক ঘাম, রক্ত ঝরিয়ে। মহাভারতে অর্জুন বলেছিলেন – পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় দোষ হল দারিদ্র্য, যা অন্য সব গুণকে ঢেকে দেয়। তাই প্রত্যেক মানুষের উচিৎ ধন অর্জনে উদ্যমী হওয়া।
“বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী, তদর্ধং কৃষি কর্মণি তদর্ধং রাজ সেবায়ং,ভিক্ষায়াং নৈব নৈবচ।”
এই শ্লোকের প্রথম পর্ব বাঙালি জানে –
লক্ষ্মীর বাস বণিকের ঘরে, দেবী তার অর্ধেক কৃপাদৃষ্টি দেন কৃষককে, তারও অর্ধেক দেন রাজার সেবকদের – অর্থাৎ চাকুরীজীবিদের; আর ভিক্ষুককে মোটে কৃপা করেন না।
অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় – যাঁরা শাস্ত্র মতে লক্ষ্মীর সবচেয়ে কৃপাধন্য, সেই ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের প্রতি বেশির ভাগ বাঙ্গালীর প্রবল অনীহা। ভক্তিভরে বণিক ধনপতির সিংহল যাত্রার পাঁচালী পড়ব, চাঁদ সওদাগরের কাব্যে মুগ্ধ হব, দ্বারকানাথের ব্যবসাবুদ্ধি নিয়ে থিসিস লিখব, কিন্তু নিজের ঘরের মেধাবী পুত্রকন্যা যখন ব্যবসা করতে চাইবে – প্রেসার তালগাছে উঠবে।
আদানি, আম্বানির কার্যকলাপ নিয়ে খিল্লী করব, টাটার অপকর্ম নিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দেব, কিন্তু ছেলেমেয়ে যখন ওইসব সংস্থায় চাকরি নেবে, তখন বুক ফুলিয়ে গর্ব করে বেড়াব।
ভাবলেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, বিল গেটস বা মার্ক জাকারবার্গরা যদি বাঙালি বাপ-মায়ের ঘরে জন্মাতো, তবে কী হত, ‘লক্ষ্মী বাবু, ব্যবসার ভূত ঘাড় থেকে নামা! BCS টায় বোস বরং!’
যতদূর মনে আছে, বিখ্যাত বাঙালি ব্যবসায়ী একবার বলেছিলেন, এক সুপাত্রীর গার্জেনরা তিনি ব্যবসা করেন বলে তাঁকে রিজেক্ট করে, তাঁরই কোম্পানির এক মোটা মাইনের একজিকিউটিভের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন।
আমাদের কতগুলো ফেভারিট হাইপোথিসিস আছে, যেমন – পলিটিশিয়ান মাত্রই অসৎ, ব্যবসায়ী মাত্রই চোর আর অশিক্ষিত। আর তাই ছেলেপুলেদের সে সব থেকে শত হস্ত দূরে রাখতে হবে।
কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে খানিক কলরব করুক ঠিক আছে, কিন্তু পাশ করা মাত্র প্যাকিং করে কন্টিনেন্ট বা স্টেটসে পাঠিয়ে দাও, নিদেন পুনা বা ব্যাঙ্গালোর। তাই ছাত্র রাজনীতিতে তুফান তোলা ঝকঝকে চেহারাগুলোর বেশির ভাগকেই রাজনীতির মূলস্রোতে দেখা যায় না।
প্রকৃতির নিয়মেই কোনো জায়গা ফাঁকা থাকেনা, সেই স্থান দখল করে তথাকথিত অযোগ্য মানুষগুলো। তাঁদের দ্বারা শাসিত হয়ে, ফেসবুক বিষ উগরেই কাল কাটাতে হবে, সমাজের কিস্যু পরিবর্তন হবে না, কারণ পরিবর্তনের সদিচ্ছাই তো আমাদের নেই। কোনো বাঙালি পদস্থ মানুষ সাহস করে রাজনীতিতে আসার কথা বললে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে, অথচ IITর উজ্জ্বল ছাত্র অরবিন্দ কেজরিওয়াল যখন আমলার পদ ছেড়ে রাজনীতিতে আসেন, তখন বাঙালি বাহবা দিতে ভোলে না। এমনকি যে দুর্নীতির বিরোধিতা করে তাঁর রাজনীতিতে আসা, সেই দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে না পারলেও তাঁকে বেনিফিট অব ডাউট দিতে আমরা উদার হস্ত । মানে আমরা তীরে দাঁড়িয়ে ক্ল্যাপ দেব, কিন্তু নিজেরা জলে নামবো না।
ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টিভঙ্গী।
বাঙালি মতে ব্যবসা করে কারা? না, যারা চাকরি বাকরি পায় না।
দুনিয়ার ব্যবসায়ীর ইতিহাস ভূগোল গুলে খেয়েও বাঙালি স্বীকার করবে না – ব্যবসা দুনিয়ার অন্যতম কঠিন কাজ, সেরা মেধার দরকার হয় তাতে। একটা সফল ব্যবসার মালিক হতে গেলে – ক্ষুরধার মেধা, সঠিক সময়ে ডিসিশন নেওয়ার ক্ষমতা,মনোযোগ, দূরদৃষ্টি, নিস্পৃহতা, ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা – সব রকম সদগুন লাগে। নিজেরটা ভাবলেই চলে না, তার ওপর নির্ভরশীল আরো পাঁচটা পরিবারের সুখদুঃখের কথাও ভাবতে হয়।
আমরা ঘরে ঘরে সেরা মাথাগুলোকে অন্যের গোলামী করতে বাধ্য করছি, সেই ফাঁকা জায়গায় ভারতের অন্য প্রদেশের মেধাবী মানুষরা এসে বঙ্গলক্ষ্মীকে আঁচলে বেঁধে নিয়ে চলে যাচ্ছে, আর আমরা নিজেদের শহর, নগর, মান, সম্ভ্রম সব তাঁদের হাতে তুলে দিচ্ছি। ভিনরাজ্যের ক্ষুরধার বুদ্ধির সঙ্গে এ রাজ্যের মিডিওকার ব্যবসায়ী ছেলেপুলেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এঁটে উঠতে পারছে না।
তাই, শুধু সমালোচনা ও ব্যঙ্গ না করে বাঙ্গালী মনে হয় ভেবে দেখতে পারেন – নিজেদের সন্তানরা যাঁদের কোম্পানিতে কাজ পেলে চোদ্দপুরুষ বর্তে গেল মনে করি, সেই বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গরা কেন নিমন্ত্রণ পাওয়া মাত্র – যে অসাধু, রুচিহীন, লাউড পরিবারের প্রিওয়েডিং উৎসবে এসে উপস্থিত হন, তাঁদের সাধনার দিকটাও নতুন প্রজন্মের সামনে উন্মোচন করা উচিত কিনা। শুধু উৎসবের চাকচিক্য নয়, ধীরুভাই আম্বানির লড়াইটাও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জানানো দরকার, নইলে নতুন প্রজন্ম স্বপ্ন দেখবে কি করে?
আমাদের কোনো ব্যবসায়ীর দু এক প্রজন্ম ব্যবসায় খানিক রোজগার করলেই তাঁদের ছেলেপুলে সেই টাকায় দেশ বিদেশ থেকে ডিগ্রি টিগ্রি নিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মোটা চাকরি খুঁজে বাইরেই বসবাস করছে, আর বাবা বা মায়ের ব্যবসা তাঁর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোপ পেয়ে যাচ্ছে।
কেন বাঙালি শুধু কর্মী সাপ্লাই দিয়ে যাবে চিরটা কাল? কর্মদাতা হতে অনীহা কেন?
তরুণ প্রজন্মকে বোঝাতে হবে – আমরাও সাধনা করলে পৃথিবীর সেরা ধনী হতে পারি।
তাদের বলতে হবে, তিন প্রজন্ম ধরে ভারতের সব রকম শাসকের রাজত্বে ব্যবসা করেই কিন্তু আম্বানিরা আজ পৃথিবীর সেরা ধনীদের মধ্যে একজন। শুধু চুরি করে অত উঁচুতে ওঠা যায় না। আমি যেটা পারি না, সেটাকে অশ্রদ্ধার চোখে দেখাটা পাপ।
সারা দেশের অসংখ্য মানুষ রিলায়েন্সের বিভিন্ন শাখায় কাজ করে সংসার প্রতিপালন করছেন।
আমরা কেন স্বপ্ন দেখবো না – দুটি বাঙালি ছেলেমেয়ের আশীর্বাদ হচ্ছে, আর সেখানে অতিথি হয়েছেন – বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ?
কিন্তু সে দিন কি সত্যিই আসবে? আমরা তো জন্ম থেকেই ভেবে নি – ব্যবসায়ী মাত্রই অসাধু।
ঠিক আছে, ধরে নিলাম আম্বানিরা মহাচোর; চারদিকে যে খবরাখবর পাই, তাতে বোঝা যায় বাংলাতেও চোরের অভাব নেই, তাদের মধ্যে একজন অন্তত এমন চোর হয়ে দেখাক না, যে হাজার হাজার মানুষকে সৎপথে রোজগার দিচ্ছে, বিশ্বের তাবড় ধনীদের লিস্টে নাম তুলেছে, আর তার বিয়েতে বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ কি সুন্দর পিচাইরা নিমন্ত্রণ খেতে আসছে।
আমি যা লিখেছি, তা একান্তই আমার উপলব্ধি, তা ভুল ঠিক দুটোই হতে পারে। তা নিয়ে সমালোচনা হোক, কিন্তু সেটা শোভন হোক, এটাই একমাত্র কামনা”।