এবার ‘পেঙ্গুইন’ থেকে বেরলো তসলিমা নাসরিনের ‘আমার মেয়েবেলা’র ইংরেজি অনুবাদ। নাম ‘মাই গার্লহুড’।
৫ মার্চ, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের লেখক তসলিমা নাসরিন নিজস্ব ভেরিফায়েড ফেসবুক, টুইটার অ্যাকাউন্টে অত্যন্ত আনন্দের সাথে অনুরাগীদের মাঝে শেয়ার করেছেন সে মুহূর্ত।
“বইটা হাতে নেওয়ার জন্য হাত নিশপিশ করছে। কান্ট ওয়েট।”
আনন্দের মাঝেও বেদনাটা বড় বেশি বাজে। সে বেদনা তসলিমার কোন শুভাকাঙ্ক্ষীর অজানা নয়।
১৯৯৯ সালে নিষিদ্ধ হয় তসলিমা নাসরিনের প্রথম আত্মজীবনীমূলক বই ‘আমার মেয়েবেলা’। নষ্ট ও গলিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় একটি মেয়ে যে প্রতিকূল পরিবেশের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠে তাই বর্ণনা করেছেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। অশ্লীলতার অভিযোগে বাংলাদেশ সরকার এই বইটি নিষিদ্ধ করে দেন।
সেখানে রয়েছে একটি অল্পবয়সী মেয়ের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধ, বাংগালির ওপর পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার, দেশ স্বাধীন হওয়া। আছে শেখ মুজিবের সপরিবারে খুন হওয়ার খবরে বেদনা বিহবল হওয়া।
![](https://bengali.nenow.in/wp-content/uploads/2020/03/88169130_1938173172993798_5690933930371317760_n-225x300.jpg)
গায়ে শিহরণ জাগানো ‘আমার মেয়েবেলা’ ২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান ‘আনন্দ পুরস্কার’ লাভ করে।
মর্যাদা সব জায়গায় পেল। হারালো কেবল নিজের দেশে! বাংলাদেশে!
পাঠক বন্ধু, আমরা একবার দেখে নেবো সারা বিশ্বে ‘আমার মেয়েবেলা’র মাহাত্ম্য তথা সম্মান কতটা।
১। ‘আমার মেয়েবেলা’ প্রথম বেরিয়েছিল ১৯৯৮ সালে ফরাসি ভাষায়।
২। আমেরিকায় প্রথম এই বই বেরিয়েছিল স্টিয়ারফোর্থ নামে একটা প্রকাশনী সংস্থা থেকে। বাংলা ভাষায় বেরিয়েছে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে কলকাতায়।
৩। মেয়েবেলা জার্মান ভাষায় বের হয় রুভল্ট থেকে।
এরপর আরো বহু ভাষা যেমন অসমিয়া, মারাঠি, হিন্দি, মালায়ালাম ভাষায় অনূদিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমেরিকায় এই বই ইংরেজি ভাষায় বেরোনোর পর লস এঞ্জেলেস টাইমস আর কানাডার গ্লোব এন্ড মেইল পত্রিকা একে ২০০২ সালের বেস্ট নন -ফিকশানের কাতারে সসম্মানে স্থান করে নিয়েছিল।
![](https://bengali.nenow.in/wp-content/uploads/2020/03/89037219_1938173212993794_8073213875551469568_n-225x300.jpg)
বৃহস্পতিবার, পেঙ্গুইন প্রকাশনি সংস্থা থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে বইটি বের হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে বেরোবে আগামি ১৬ মার্চ।
তবে অ্যামাজন (আমাজন ডট ইন) ইতিমধ্যে প্রি-অর্ডার নেয়া আরম্ভ করেছে। সারা বিশ্বের পাঠকের সাথে আপনিও উদযাপন করুন এই আনন্দ। আর কতো আড়ালে-আবডালে থাকা?
নারীবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ লেখক তসলিমার তথ্যভিত্তিক; মূল্যবান বইটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করছেন না। তথা দেশের জনগণও এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
লেখক লিখেছেন,
“আমার বই বেরোলে, কলকাতায় যে বাংলাদেশ কন্সুলার আছেন, তাঁদের প্রথম কাজ বইটি কিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া। তখন শেখ হাসিনা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বইটি পড়লেন তিনি। বইটিতে আছে একটি অল্পবয়সী মেয়ের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধ, বাংগালির ওপর পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার, দেশ স্বাধীন হওয়া। আছে শেখ মুজিবের সপরিবার খুন হওয়ার খবরে বেদনা বিহবল হওয়া। এই সবের সংগে একটি মেয়ের বড় হওয়ার গল্প। অসংখ্য মেয়ের মতো তাকেও একদিন যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল। বইটি পড়ার পর কী করলেন শেখ হাসিনা? বইটিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করলেন। যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয় অনেক শিশুকেই, এই বাস্তব সত্যটি তুলে ধরেছি বলে তিনি আমাকে দোষী করলেন। বইটি, তাঁর চোখে, অশ্লীল বই, ‘ভাল্গার’ বই। অশ্লীলতার দোষ দিয়ে বইটিকে নিষিদ্ধ করলেন। বইটি বেরোলোই না বাংলাদেশে, তার আগেই নিষিদ্ধ।
শেখ হাসিনা যে বইটি নিষিদ্ধ করেছেন অশ্লীলতার দোষে, সে বইটি কত যে প্রশংসা পেয়েছে নানা দেশে!
![](https://bengali.nenow.in/wp-content/uploads/2020/03/88353763_1938173139660468_6248090990817574912_n-225x300.jpg)
শেখ হাসিনার লজ্জা হয় না এসব পড়লে? নাকি তিনি জন্মেছেনই নির্লজ্জ হয়ে? তাঁর ভয়ে বইটি থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার দাবিও কেউ করে না। গণতন্ত্র মানেন না, বাক স্বাধীনতা মানেন না। চাটুকার, চোর, আর চক্ষুলজ্জাহীন বেষ্টিত জীবন তাঁর!”
উল্লেখযোগ্য যে, ‘আমার মেয়েবেলা’ ছাড়াও দেশে নিষিদ্ধ আরো ৫ টি বই।
১। লজ্জাঃ
১৯৯৩ সালে সরকারী এক তথ্যবিবরনীর মাধ্যমে তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। সেই তথ্য বিবরণী অনুযায়ী, জনমনে বিভ্রান্তি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্ট এবং রাষ্ট্র বিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্যপ্রকাশিত হওয়ার জন্য ‘লজ্জা’ নামক বইটির সকল সংস্করণ সরকার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। প্রকৃতপক্ষে মৌলবাদীদের আন্দোলনের কাছে মাথা নত করা সরকার বাধ্য হয় বইটিকে বাজেয়াপ্ত করতে। মৌলবাদীরা তসলিমাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করে।
২। উতল হাওয়া:
‘আমার মেয়েবেলা’র দ্বিতীয় খণ্ড ‘উতল হাওয়া’ প্রকাশিত হয় পশ্চিমবঙ্গ থেকে। বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বইটিতে ইসলাম বিরোধী তথ্য থাকার অভিযোগে বইটিকে নিষিদ্ধ করে দেয় ২০০২ সালে আগস্ট মাসে। সেখানেও বলা হয়, এই বই ধর্মীয় সম্প্রীতিতে আঘাত হানতে পারে।
৩। ‘ক’:
ময়মনসিংহের স্থানীয় ভাষায় ‘ক’ অর্থ ‘বলা’। ২০০৩ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর সাহিত্য ও মিডিয়া অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে। সে বইয়ে যৌনতা ও ধর্ম বিষয়ে নিজের মতামত তুলে ধরেছেন তসলিমা। ইমদাদুল হক মিলন, সৈয়দ শামসুল হক সহ বিভিন্ন জনকে জড়িয়ে নিজের জীবনের ঘটনা ব্যক্ত করেন। কবি ও ঔপন্যাসিক সৈয়দ শামসুল হক তসলিমার বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার মানহানীর মামলা করে দেন। ফলে হাই কোর্ট কর্তৃক নিষিদ্ধ হয় তসলিমা নাসরিনের ‘ক’।
৪। দ্বি-খণ্ডিত:
আমার মেয়েবেলার তৃতীয় খণ্ড ‘দ্বি-খণ্ডিত’ নিষিদ্ধ পশ্চিমবঙ্গে ২৮ নভেম্বর, ২০০৩ সালে। বাংলাদেশে ‘ক’ নিষিদ্ধ হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে ‘দ্বি-খণ্ডিত’ নামে বইটি প্রকাশিত হয়। কিন্তু এন্টি-ইসলামিক বিষয় থাকার অভিযোগে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
৫। সেই সব অন্ধকার:
ইসলাম ধর্ম ও হযরত মুহাম্মদ (স:) সম্পর্কে কূটক্তি থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪ সালে নিষিদ্ধ করে ‘সেই সব অন্ধকার’ বইটি। সমাজকে আঘাত হানতে পারে এই ভয়ে তসলিমা নাসরিনের এই বইটিকেও আটকে দেয়া হয় নিষিদ্ধতার বেড়াজালে।
নিউজ পোর্টেলের পক্ষ থেকে তসলিমা নাসরিনের প্রতি রইল সুন্দর আগামির শুভেচ্ছা!