ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। ইতিহাসহীন মানুষ স্মৃতিভ্রংশ মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ।
১৯৫০ সালের পয়লা নভেম্বর চিরকালের জন্যে প্রিয় প্রকৃতিকে ছেড়ে চলে গেছিলেন বাঙালি কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁর রচনা কেবলই ঝড় তুলে মনে। সে শান্ত, নস্টালজিক ঝড় আজীবন বয়ে চলেছে, চলবে।
এই একই দিনে উনবিংশ শতাব্দী, ১৮৭৩ সাল, আজকের দিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা নাট্য আন্দোলনের অন্যতম কারিগর দীনবন্ধু মিত্র।
আজ দুই মহান মানবের প্রয়াণ দিবসে ‘নর্থ ইস্ট নাও’ এর পক্ষ থেকে জানানো হলো গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব।
প্রতিদিন আমাদের শয়নে-স্বপনে অপু-দুর্গা তো রয়েছেই। আজ আরও একবার অনুভব করবো তাঁদের সেই মমতাভরা, স্নিগ্ধ ছুটে চলা।
অপু-দুর্গা
“দিদি খাসনি !” কিন্তু দিদি কি আর শোনে !!??
সে বনে বনে আঁচল উড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় ।
দুষ্টু ভাই তার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে,,,দিদি পুকুর থেকে পানফল তোলে।
নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম সদা জাগ্রত, দু ভাই -বোনের ছুটাছুটিতে।
কিন্তু আত্মা থমকে দাঁড়ায় এক জায়গায় । সমগ্র কাহিনির চরম মর্মান্তিক দৃশ্য!!
চিনিবাস ময়রা থাকে ও পাড়ায়। সে জানে হরিহরের দুয়ার দিয়ে মিষ্টি নিয়ে গেলেও নেবার কেউ নেই। তাই আর সে ওখানে দাঁড়ায় না। মুখুজ্যেদের বাড়ির দিকেই রওনা দেয় ।
সরল অপু -দুর্গা চিনিবাসের পেছন পেছন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ছুটে চলে ।
আজো বিভূতিভূষণ… 2
সেই চেনা ছবি
ভাই – বোন সবুজ, তাইতো তারা অবুঝ~~
উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলে যেন তীক্ষ্ণ চাবুক।
কিন্তু এ ছুটা , এ দেখা বিশুদ্ধ দেখা, নির্লোভ দেখা !
তাদের সামর্থ্য নেই, কিন্তু লোভও নেই ।
মুখুজ্যে বাড়ি বলতেই পারে, বুভুক্ষু আত্মার নজর লেগে
তার সন্তানের শরীর খারাপ করবে ,, কিন্তু প্রকৃতি কখনোই বলে না । সে তাদের মুক্ত হৃদয়ে সর্বস্ব দান করছে।
অপু- দুর্গা র জিভ কিনে খাওয়া মিষ্টির স্বাদ পায়নি ঠিকই , কিন্তু পানফলের স্বাদ পেয়েছে !
অপু-দুর্গার নামেই বাঙালির স্মৃতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে ‘পথের পাঁচালি’র স্রষ্টা বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। তাই না? বাংলার সাহিত্যিকের আজ ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী।
তাঁর রচনায় প্রকৃতির সৌন্দর্য ও গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনের সতেজ চিত্র পাওয়া যায়। শরৎচন্দ্র পরবর্তী বাঙালি ঔপন্যাসিকদের মধ্যে বিভূতিভূষণ অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলা সাহিত্যে তাঁর রচনা মৌলিক হিসেবে পরিচিত।
সাধারণ হয়েও অসাধারণ শব্দের গাঁথুনিতে তাঁর সৃষ্টি হয়ে উঠেছে সেরা। তাঁর লেখার শৈলি পাঠককে জায়গা ছেড়ে উঠতে দেয় না। তাঁর সাহিত্যে প্রকৃতি উঠে এসেছে জ্যান্তব হয়ে!
বাস্তবের কঠোরতাকে অতিক্রম করে নয়, তাঁর সাহিত্য শেখায় কঠিন সময়ের মধ্যেও কোন কৌশলে কোমল থাকা যায়, মানবিক থাকা যায়। সরস মনেই সৃষ্টির বীজ বপন করা যায়। সেই বীজ বপন করতে, মনকে সদা উর্বর রাখতে সাহায্য করে তাঁর এক-একটি সৃষ্টি।
বিভূতিভূষণ তাঁর সাহিত্যে প্রকৃতি ও মানব জীবনকে অবিচ্ছিন্ন সত্তায় ধারণ করেছেন। তার রচনা শুধু প্রাকৃতিক বর্ণনা নয়, এতে রয়েছে গভীর জীবনবোধ। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী ও অপরাজিত বাংলা সাহিত্যের দুই অমূল্য সম্পদ। যদিও তার সব লেখাই উল্লেখ করার মতো।
তাঁর ছোট গল্পগুলোর মধ্যে গীতিকবির দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : পথের পাঁচালি (১৯২৯), অপরাজিত (১৯৩১), দৃষ্টি প্রদীপ (১৯৩৫), আরণ্যক (১৯৩৮), আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০), দেবযান (১৯৪৪), ইছামতী (১৯৪৯)।
উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার দীনবন্ধু মিত্র। বাংলার আধুনিক নাট্যধারার প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমসাময়িক দীনবন্ধু মিত্র অবশ্য মাইকেল প্রবর্তিত পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক নাট্যরচনার পথে না গিয়ে বাস্তবধর্মী সামাজিক নাট্যরচনায় মনোনিবেশ করেন। এই ধারায় তিনিই হয়ে ওঠেন পরবর্তীকালের নাট্যকারদের আদর্শস্থানীয়।
তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক নীলদর্পণ সম্বন্ধে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বলেছিলেনঃ
“নীলদর্পণ’ নাটক প্রকাশিত হলে এবং এর ইংরেজি অনুবাদ প্রচারিত হলে একদিনেই এ নাটক বাঙালিমহলে যতটা প্রশংসিত হয়েছিল, শ্বেতাঙ্গমহলে ঠিক ততটাই ঘৃণিত হয়েছিল। এই নাটক অবলম্বন করে বাঙালির স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সূচনা, এই নাটক সম্বন্ধে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ও রায়তদের মধ্যে মৈত্রীবন্ধন স্থাপিত হয়, এর মধ্যে দিয়েই শ্বেতাঙ্গ নীলকরদের বর্বর চরিত্র উদ্ঘাটিত হয়।”