ত্রিপুরা

ভূমিপুত্র ব্রু’দের সঙ্গে শরণার্থীর আচরণ পীড়াদায়ক! সংবিধান লংঘন সরকারের, শীঘ্রই ত্রিপুরি রাজসন্তান প্রদ্যোৎ হাইকোর্টে আবেদন করবেন

“নিজের মাটিতে ভূমিপুত্রের সঙ্গে শরণার্থীর আচরণ করতে দেখার মতো যন্ত্রণাদায়ক আর কিছু নেই। ত্রিপুরার ব্রু শিবিরে রেশন বন্ধ করে সরকার আমাদের অধিকার লঙ্ঘন করেছে।”

সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এবং ১৯৭৬ সালে উন্নয়ন (ডুম্বুর নদীবাঁধ) এর বলি হয়ে অসহনীয় জীবন কাটানো ব্রু (রিয়াং) দের অধিকার নিয়ে এবার সরব হয়েছেন ত্রিপুরি রাজসন্তান প্ৰদ্যোৎ কিশোর দেববর্মা। বুধবার তিনি তীব্র ভাষায় ব্রুদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন।

কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে শেষবারের মতো রেশন যোগান দেওয়া বন্ধ করে দেবার পর বুভুক্ষু অবস্থায় প্রাণ হারাচ্ছে ব্রু’রা। এমন অমানবিক সরকার কি করে হতে পারে!

খাদ্যহীন, শুকিয়ে যাওয়া ব্রুদের জন্যে খাবার নিয়ে উদবাস্তু শিবিরে উপস্থিত হয়ে সদ্য কংগ্রেসত্যাগী দেববর্মা যন্ত্রণাকাতর ভূমিপুত্রদের স্বপক্ষে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেন।

“এই মাটি আপনাদের। এ স্থান ছেড়ে আপনাদের যাওয়ার জন্যে কেউ জোর খাটাতে পারবে না। রিয়াং মানুষ রাখার মতো ত্রিপুরার যথেষ্ট জায়গা আছে। আমি ত্রিপুরা এবং মিজোরাম সরকারের সঙ্গে কথা বলবো।”

প্রদ্যোৎ দেববর্মা প্রশ্ন করেন, “বিএসএফ ফায়ারিং রেঞ্জের জন্যে কাঞ্চনপুরে যদি ২৭০০ একর জমি সরকার পক্ষ দেওয়ার জন্যে রাজি হতে পারে তাহলে আমাদের বিতাড়িত, অসহায় লোকদের জন্যে কেন পারবে না?”

তিনি পাশাপাশি এও বলেন যে, ব্রু উদবাস্তু ক্যাম্পে ভারত সরকারের রেশন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি অতি শীঘ্রই হাইকোর্টে লিখিত আবেদন দাখিল করবেন।

“ভারতীয় সংবিধানের ২১ নং অনুচ্ছেদ আমাদের খাদ্যের অধিকার দিয়েছে। সংবিধানবিরোধী সরকারের এই সিদ্ধান্তকে কখনো মেনে নেয়া হবে না। কেন্দ্র আমাদের অধিকার লংঘন করছে।”

ব্রু’দের আমাদের লোক উল্লেখ করে দেববর্মা বলেন, ত্রিপুরার ডুম্বুর নদীবাঁধের ফলে ভূমিহীন হয়ে পড়া ভূমিপুত্ররা মিজোরামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

ভারতবর্ষেরই ৭৫টি আদিম উপজাতি  (primitive tribe) এর একটি রূপ হিসেবে স্বীকৃত ত্রিপুরার গোমতি নদীর বাঁধের ফলে যে ভূমিহীন হয়েছিল ওরা, এটা নিশ্চিত।

কিন্তু ফের এই লোকেরাই যে আভ্যন্তরীণ শরণার্থী হিসেবে ত্রিপুরায় ফিরে এসেছিল তার কোন প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।

বিপরীতদিকে, মিজোরামও পাহাড়িয়া এই জনজাতিটির আদিম বাসভূমি। বর্তমান মিজোরামেও ৪০ হাজার ব্রু লোক থাকার পাশাপাশি উত্তর ত্রিপুরার উদবাস্তু শিবিরে প্রায় ৩৫ হাজার ব্রু মানুষ বসবাস করছে।

একটি গবেষণাপত্রে পাওয়া গেছে, “গোমতি প্রকল্পের ডুম্বুর বাঁধে….৫৮৪৫ জনজাতি পরিবার…মোট ৩৫ থেকে ৪০ হাজার মানুষকে স্থানান্তরিত হতে হয়েছিল।”

বলা বাহুল্য, ১৯৭৬ সালে উন্মুক্ত করা ১০ মেগাওয়েট ক্ষমতার বাঁধটিতে এখনো পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় না, কারণ গোমতির জল শুকিয়ে গেছে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রিয়াং (ব্রু) দের আদিম বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করে নির্মাণ করা ৪২ কিমি এলাকা জুড়ে বাঁধের জলাশয়টি বর্তমান পর্যটকের পাখি দর্শনের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়েছে। সিপিআইএম সরকারের জমানায় ২০১২ সাল থেকে এটি দেখা গেছে।

২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ত্রিপুরা রাজ্যে ব্রু-র সংখ্যা ১,৬৫,১০৩ জন।

কেন্দ্রের সরকার মিজোরাম এবং ত্রিপুরা সরকারের সঙ্গে জোট বেধে ত্রিপুরার উদবাস্তু শিবিরে আশ্রয়রত ব্রু-লোকেদের মিজোরামে ঘুরিয়ে নেবার চেষ্টা চালাচ্ছে।

‘১৯ অক্টোবর সরকারের নবম প্রচেষ্টায় প্রায় ৭০০ ব্রু মিজোরামে ফিরে যেতে রাজি হয়েছিল।’

কিন্তু বিগত ৫ অক্টোবর তারিখে মিজোরামে সংঘটিত একটি মর্মান্তিক ঘটনা কেন্দ্রের প্রচেষ্টাকে ফের বিফল করে দেওয়ার খবর প্রকাশিত হয়।

উল্লেখ্য, মিজোরামের মামিত জেলায় ফিরে যাওয়া লিন্দা রিয়াং নামক এক ৩৩ বছরের ব্রু মহিলাকে সেদিনই তাঁর মিজো স্বামী জীবন্ত জ্বালিয়ে মেরে ফেলেন।

সূত্রে লাভ করা খবর অনুযায়ী,পূর্ব থেকেই আতংকিত ব্রু-রা ফের এই ঘটনায় শংকিত হয়ে পড়ে নিজের জীবন নিয়ে। মিজোরামে ফিরে যেতে তাঁরা কোনভাবেই সাহস করতে পারছে না।

১৯৯৭ সালে একজন মিজো বনবিভাগের কর্মচারীকে হত্যা করা নিয়ে মিজো এবং ব্রু-র মাঝে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সূচনা হয়েছিল।

ফলে সরকারের শত আশ্বাসেও তাঁরা ফিরে যেতে চাইছে না।

প্রসঙ্গত, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, ধর্মীয় রাজনীতি মানবিকতা নষ্ট করে ফেলছে দেশের।

খবর অনুযায়ী, ব্রু-রা একসঙ্গে সকলকে মিজোরামে ফের সংস্থাপন করানোর পক্ষে রয়েছে।

মিজোরাম ব্রু ডিসপ্লেসড পিপলস ফোরাম (MBDPF) নর্থ ইস্ট নাও-কে জানিয়েছেঃ ত্রিপুরার কাঞ্চনপুর,নাইসিংপাড়ার এবং হামসা পাড়া ব্রু শরণার্থী শিবিরে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে।

এমবিডিপিএফ নেতারা আরো জানাচ্ছেন, “খাবার না পেয়ে করুণ মৃত্যুকে গ্রহণ করে নিয়েছে ৩ বছরের আজিতারি রিয়াং এবং ৪ মাসের শিশু পিগলি রিয়াং। ৩ নভেম্বরে মণিরাম মলসৈর ২ বছরের পুত্র আকস মলসৈ এবং ঘমা রিয়াংয়ের স্ত্রী বৃষ্টিরুং রিয়াং (৬৫ বছর) বৃদ্ধ এবং জন সংপ্রেংথ নামের একজন ২ বছরের শিশু মারা গেছে। কেন্দ্রীয় সরকার এর জন্যে দায়ী।”

এখনও পর্যন্ত সেখানে চিকিৎসা পরিষেবা এবং পানীয় জলের জোগান পৌঁছয়নি বলে জানিয়েছেন এমবিডিপিএফ নেতৃত্ব। তাঁদের অভিযোগ, চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে ত্রিপুরা সরকার। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবে উদ্বাস্তুদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলছে ত্রিপুরা সরকার, যাতে রাজ্য থেকে বেরিয়ে যান তাঁরা।

ফোরামের নেতা আরো জানিয়েছেন, খাদ্যের অভাবে মায়ের স্তন শুকিয়ে যাচ্ছে, শিশুরা মুখ ফেটে, বুক ফেটে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। পরিস্থিতি দিনের পর দিন আরো মন্দার দিকে গতি করছে।

তিনি বলেন, শিবিরে বহু বয়স্ক মানুষ এবং শিশুরা গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

বৰ্তমান ত্রিপুরায় থাকা মিজোরামের সাংসদ রোনাল্ড চাপা ব্রুদের ভয়াবহ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্যে কেন্দ্রীয় গৃহ বিভাগের তরফ থেকে শীঘ্রই একটি দল পাঠানো প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন।

ভয়ংকর, মানবতাহীন এই ঘটনায় ত্রিপুরার বিরোধী দল তীব্র সমালোচনা করেন বিপ্লব দেব সরকারের।

“এই মানুষগুলো শুধুমাত্র না খেতে পেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে, আর আমাদের সরকার এখনো মুখ বুজে রয়েছে। সরকার যে কাজ করছে তা অত্যন্ত অমানবিক।”

ব্রু লোকেদের শিগগির খাবার জোগানের জন্যে আহ্বান জানিয়েছেন ত্রিপুরা কংগ্রেসের মুখপাত্র তাপস দে।

সিপিআইএম(এ) ব্রুদের জন্যে ফের সাহায্য শুরু করার জন্যে সরকারের প্রতি দাবী জানিয়েছেন।

ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, শিবিরে বহুদিন ধরে অবস্থান করা ব্রুদের প্রথম মিজোরামে যাওয়া উচিৎ।

“কোন বিকল্প নেই, তাঁরা প্রথমে গৃহভূমি মিজোরামে ফিরে যাক, কেন্দ্র এবং মিজোরাম সরকার তাঁদের সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে।” সংবাদ মাধ্যমে এ কথা জানিয়েছিলেন বিপ্লব দেব।

বিগত অক্টোবর মাসে ব্রু লোকেদের মিজোরামে পুনর্বার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কেন্দ্র। কিন্তু নবমবারের প্রচেষ্টাও বিফল হওয়ার পর সমস্ত সাহায্য বন্ধ করে দেয়া হয় কেন্দ্রের পক্ষ থেকে।

এই প্রচেষ্টাকে ‘অন্তিম’ বলে উল্লেখ করে কেন্দ্র বলেছিল, ত্রিপুরার কাঞ্চনপুরে থাকা শরণার্থী শিবির আর রাখা হবে না।

কিন্তু, খবর পাওয়া গেছে, মিজোরাম এবং ত্রিপুরা সরকারের প্রচেষ্টায় ২৩ অক্টোবর প্রায় ৭০০ লোক (১২৫ টি পরিবার) নিজস্ব ভূমিতে ফিরে যেতে রাজি হয়েছিল।

এদিকে গৃহহীন, খাদ্যহীন শরণার্থী ব্রু’রা পথে নেমে এসেছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত বিগত এক সপ্তাহ ধরে তাঁরা আনন্দবাজার দাশ্বদা পথ অবরোধ করে রেখেছে।

ত্রিপুরার কাঞ্চনপুরের পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে পড়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালে সংখ্যাগুরু মিজোর সঙ্গে হওয়া সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পর ৩০/৪০ হাজার ব্রু ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়।

বর্তমান সময়ে মিজোরামে প্রায় ৪০ হাজার ব্রু মানুষ অবস্থান করার বিপরীতে উত্তর ত্রিপুরার শরণার্থী শিবিরে প্রায় ৩০ হাজার ব্রু লোক আশ্রয়রত।

 

 

 

 

 

 

 

এন ই নাও নিউজ

Recent Posts

বাংলাদেশে হিটস্ট্রোকে উপজেলা মহিলা ভাইসচেয়ারম্যান প্রার্থীসহ  ৪ মৃত্যু, স্থগিত নির্বাচন

ঢাকা: বাংলাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে অতি গরমের ফলে হিটস্ট্রোকে ৩৭ জন মারা গিয়েছেন।…

6 days ago

বাংলাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহে রেললাইন বেঁকে ট্রেন চলাচল বিঘ্ন

ঢাকা: বাংলাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহে রেললাইন বেঁকে ট্রেন চলাচল বিঘ্ন ঘটছে। যাকে রেলের ভাষায় বলা হয়…

6 days ago

সাপ্তাহিক রাশিফল

মেষ রাশির জাতক জাতিকাদের জন্য সপ্তাহটি ভালোই হতে চলেছে। অর্থ উপার্জন হবে। সমাজে সম্মান বাড়বে।…

7 days ago

বাংলাদেশে তাপদাহে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুনঈশ্বরদীতে রেললাইনের পাত বেঁকে গেছে

ঢাকা: বাংলাদেশে চলতি বছর সীমাহীন তাপদাহে মানুষের জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশে সরবোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে…

1 week ago

আপনার আজকের দিনটি

সিংহ: আজকের দিনটি আপনার জন্য নতুন কিছু শেখার দিন হবে। ভাগ্যের দিক থেকে দিনটি ভালোই।…

1 week ago

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত

ঢাকা: বাংলাদেশে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে আবুল কালাম (২৫)…

1 week ago