কলকাতা: খুব খারাপভাবে এবং কাঁচা ভাষায় মেয়েদের সমালোচনা করেছেন অভিনেত্রী মমতা শঙ্কর।
আজকাল মেয়েরা যে ভাবে শাড়ি পরে, তাদের আঁচল ঠিক থাকে না। এমনটাই বলেন কলকাতার বর্ষীয়াণ অভিনেত্রী মমতা শঙ্কর।
কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রকৃতি ও নারীত্বের উদযাপন নামের এক সাংস্কৃতিক আয়োজন। সেখানে এই ধরনের বলেছেন মমতাশঙ্কর।
ইশতিয়াকের আহমেদের নাটক ‘শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’
প্রদর্শনীতে মমতাশঙ্কর বললেন, পুরনো জিনিসকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে। পুরনো জিনিসের একটা আভিজাত্য আছে। আজকাল মেয়েরা যে ভাবে শাড়ি পরে, তাদের আঁচল ঠিক থাকে না। ক্ষমা করবেন এটা বলছি, রাস্তার মেয়েরা ল্যাম্পপোস্টের নিচে যে ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সে ভাবে এখনকার মেয়েরা শাড়ি পরে।
তারা তো পেশার তাগিদে পুরুষদের আকর্ষণ করার জন্য ও ভাবে শাড়ি পরে থাকেন। কিন্তু বাকি মেয়েরা বিনা কারণে সেটা কেন করছে?”
বলেন, মেয়েরা ও ভাবে শাড়ি পরবে তার পরে ছেলেরা কিছু বললে রেগে যায়। বলবে, মেয়েদের অসম্মান করা হচ্ছে। মেয়েদের একটা শালীনতার জায়গা আছে যা দেখে ছেলেরা সম্মান করবে। আমাদের নিজেদের যদি এই মর্যাদা না থাকে তা হলে ছেলেরা সম্মান করবে কী ভাবে! আমি এর প্রতিবাদ করছি।
কিন্তু সম্মান-অসম্মান তো পোশাকের ওপর নির্ভর করে না?
এর পাল্টা জবাব অভিনেত্রীর, প্রথম দেখাতেই তো একটা ধারণা তৈরি হয়। আমি হয়তো খুব ভালো মেয়ে কিন্তু শাড়িটা ওই ভাবে আমি পরব কেন? নিজেকে ও ভাবে দেখাতে যাব কেন!
এই কথার তীব্র বিরোধিতা করলেন লেখক তসলিমা নাসরিন।
তিনি লিখেছেন:
“আমি কখনও শাড়ির আঁচল বুকের মাঝখান দিয়ে নিই না। বক্ষযুগলের ওপরেই থাকে আমার শাড়ির আঁচল। কিন্তু বক্ষযুগলকে আঁচল দিয়ে যারা আড়াল করতে না চায়, তাদের এই না-চাওয়াকে কেন অশালীন বলা হবে? কোন যুক্তিতে? ব্লাউজের ওপর শাড়ির কোনও আঁচল পরতে আদৌ যদি কারও ইচ্ছে না করে, পরবে না। পরলে শালীনতা বজায় থাকে, না পরলে শালীনতা থাকে না — শালীনতার এই সংজ্ঞা কারা তৈরি করলো?
যারা তৈরি করেছে, তারা মনে করে মেয়েদের গোটা শরীরটাই লজ্জাস্থান, স্তন সবচেয়ে ভয়ংকর লজ্জাস্থান। সুতরাং স্তনের লজ্জা ঢাকার জন্য মেয়েদের শরীরে বাড়তি কাপড়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু কাঁচুলিতে হবে না, ব্লাউজ লাগবে, শুধু ব্লাউজে হবে না, দোপাট্টা লাগবে বা আঁচল লাগবে, শুধু কামিজে হবে না, ওড়না লাগবে, কেউ কেউ দ্বিগুণ আতঙ্কে বলে দোপাট্টা বা আঁচলেও কাজ হবে না, বোরখা লাগবে, নিকাব লাগবে, হিজাব লাগবে।
পুরুষেরা কি জানে না মেয়েদের শরীরে যে দুটো ম্যামারি গ্ল্যাণ্ড আছে, যে দুটোকে বাংলায় স্তন বলা হয়? যা কিছু দিয়েই স্তন আড়াল করা হোক, তারা তো জানেই আড়ালে কী আছে। আড়াল করা থাকলেও তো পুরুষ নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়, ঠিক যেরকম পুরুষকে দেখে নারীও পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আকৃষ্ট হওয়া বন্ধ হয়ে গেলে তো মানবজাতির ওপর ধ্বস নেমে আসবে।
আকৃষ্ট হলেই যে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় না কারও ওপর, এই শিক্ষাটা দিতে হয় সবাইকে। ঘরে বাইরে, পত্র পত্রিকায়, স্কুলে কলেজে, রেডিও টেলিভিশনে। সেটা না করে মেয়েদের শরীরে ঘুংঘট আর ঘোমটা চড়ানোটাই চূড়ান্ত অশালীনতা, অশ্লীলতা।
মেয়েদের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি ঢেকে রাখার চেষ্টা বহু শতাব্দি ধরে চলছে। মেয়েদের শরীরকে , সত্যি বলতে, শরীর ভাবা হয় না, ভাবা হয় আস্ত যৌনাঙ্গ। সে কারণেই জনসমক্ষে যৌনাঙ্গ ঢেকে রাখাকে যেমন শালীনতা বলে ভাবা হয়, মেয়েদের সারা শরীর ঢেকে রাখাকেও শালীনতা বলেই ভাবা হয়। যারা পা’কেও যৌনাঙ্গ বলে মনে করে, তারা মেয়েদের ছোট শর্টস বা ছোট স্কার্ট পরার বিরোধী।
যারা বাহুকে যৌনাঙ্গ বলে মনে করে, তারা মেয়েদের ফুলহাতা ব্লাউজ বা ফুলহাতা জামা পরার পরামর্শ দেয়। যারা মেয়েদের কবজি এবং আঙুলকেও, পা এবং পায়ের পাতাকেও যৌনাঙ্গ বলে মনে করে, তারা মেয়েদের হাতমোজা আর পা মোজা পরার উপদেশ দেয়। সারা শরীরে শুধু চোখ খোলা রাখার অনুমতি জোটে অনেক মেয়ের। সম্ভব হলে চোখও তারা বন্ধ করে দিত, কিন্তু হোঁচট খেয়ে পড়ে মরে গেলে পুরুষেরই বিপদ। পুরুষেরাই যৌন বস্তুকে অক্ষত রাখে পুরুষের স্বার্থেই।
বাংলার নামী নৃত্যশিল্পী এবং অভিনেত্রী মমতা শঙ্কর মেয়েদের শালীনতা বজায় রাখতে বলেছেন, তা না হলে পুরুষেরা মেয়েদের খারাপ ভাববে–এই যুক্তি দিয়ে। যে পুরুষেরা মনে করে মেয়েদের শালীনতা নির্ভর করে মেয়েরা কাপড় চোপড় দিয়ে শরীর কতটা ঢাকলো তার ওপর, সেই পুরুষদের তিরস্কার না করে মমতা শঙ্কর তিরস্কার করছেন মেয়েদের।
তিরস্কার করে তিনি যে পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক–সেটাই আবার প্রমাণ করলেন। শুনেছি তিনি সমকামিতাকে, এবং রূপান্তরকামিতাকেও তিরস্কার করেন। এবং এমন হোমোফোবিক মিসোজিনিস্ট লোকেরাই যখন আর্ট কালচারের শীর্ষে অবস্থান করেন, তখন আলোকিত হওয়ার বদলে যে অন্ধকারে পড়ে থাকবে সমাজ, এ নিয়ে কি কোনও সংশয় আছে”?