: বৈদ্যুতিক যানবাহন জলবায়ুপরিবর্তন প্রশমনের একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসাবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এধরনের যানবাহনের শূন্য-টেলপাইপ নির্গমন এবং কম ভরণপোষণ খরচের ফলে এগুলি সড়ক পরিবহন পরিষেবাতে কার্বন-নিঃসরণ হ্রাসের চাবিকাঠি হিসাবে প্রশংসিত।
বৈদ্যুতিক যানের ক্রমবর্ধমান চাহিদা সারা বিশ্বে পরিবহন দূষণ নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে সক্ষম। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভারত মূলত দুই চাকার (2WS) এবং তিন চাকার (3WS) বৈদ্যুতিক যানবাহনের প্রায় ৭৫ শতাংশ বাজার। সুতরাং, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে নীতিগুলিকে অবশ্যই এই দুই ধরনের বৈদ্যুতিক যানবাহনে ১০০ শতাংশ রূপান্তর নিশ্চিত করতে হবে।
যদিও, ২০১৫ সাল থেকে বৈদ্যুতিক গতিশীলতা সম্পর্কিত ভারতীয় নীতি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচিত হচ্ছে, তবে বলাই বাহুল্য, কোভিড-১৯ অতিমারী ভারতের বৈদ্যুতিক যানবাহন উৎপাদন শিল্পের উন্নতিকে ত্বরাণ্বিত করেছে। লকডাউনের সময় জন-পরিবহণের অভাব এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত যানবাহন রাখার প্রয়োজনীয়তা প্রাধান্য পেয়েছে।
উপরন্তু, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় Internal Combustion Engine (ICE) গাড়ির চাহিদা হ্রাস পেয়েছে এবং বৈদ্যুতিক যানবাহন, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে জনসাধারনের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।
ভারত সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে পরিবহন পরিষেবাকে কার্বনমুক্ত করার লক্ষ্যে এবং একটি উল্লেখযোগ্য মার্জিন দ্বারা অপরিশোধিত তেল আমদানি হ্রাস করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু, এই প্রসঙ্গে একটি বড় প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে পরিবহণ ব্যবস্থার বিদ্যুতায়ন কি আদৌ পরিবেশ-বান্ধব? বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলির মূল অসুবিধেগুলিই এই প্রসঙ্গে প্রধান বিবেচ্য।
একটি যানবাহনের জীবনচক্রের মোট কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ’ল সমস্ত নির্গমনের সমষ্টি, যা এর – ব্যবহার, জ্বালানীচক্র এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার ফলে ঘটে থাকে। ব্যাটারি, যা একটি বৈদ্যুতিক যানবাহনের প্রায় ৪০% , তার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রচলিত জীবাস্ম- জ্বালানী ভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি শক্তির প্রয়োজন হয়। ভারতীয় বৈদ্যুতিক যানবাহনের প্রাথমিক ব্যাটারি প্রযুক্তি হ’ল লিথিয়াম-আয়ন।
এতে বিরল ধাতুগুলির উত্তোলন এবং পরিশোধনের প্রয়োজন হয় যা উচ্চতাপ এবং জীবাণুমুক্ত পরিবেশ ব্যতীত হওয়া সম্ভব নয়। উপরন্তু, ভারতীয় বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলিতে ব্যবহৃত লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির অধিকাংশই চীন থেকে আমদানি করা হয়, যেদেশে ২০২১ সালে মোট শক্তির প্রায় ৬৭% কয়লা-ভিত্তিক তাপশক্তি ছিল।
তবে, আশার কথা এই যে, ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে প্রায় ৫.৯ মিলিয়ন টন লিথিয়ামের ভান্ডার আবিষ্কৃত হওয়ার সাথে সাথে লিথিয়ামের আমদানি সময়ের সাথে হ্রাস পাওয়ার সম্ভবনা উজ্জ্বল। তবে তারজন্য প্রয়োজন বেসরকারি ব্যবসায়ীমহলের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং যথার্থ, আধুনিক প্রযুক্তির ক্রমবর্ধান ব্যবহার।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, উৎপাদন ছাড়াও বৈদ্যুতিক যানবাহনের পরোক্ষ কার্বন ফুটপ্রিন্ট তার চার্জিং প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত, কারন এই পর্যায়ে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ জীবাশ্ম-জ্বালানি ভিত্তিক।
বিশেষকরে, ভারতের মত দেশে বৈদ্যুতিক গতিশীলতা প্রাথমিক পর্যায়ে থাকার কারণবশত, এখন পর্যন্ত স্থাপিত সীমিত সংখ্যক পাবলিক চার্জিং স্টেশনগুলি সম্পূর্ণভাবে কয়লা ভিত্তিক-বিদ্যুৎ নির্ভর। যারফলে, কাজেই বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলিকে সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধব বলা যায় না। যতদিন না সৌর ফটোভোলটাইক, বায়ু টারবাইন এবং বিভিন্ন ধরনের বায়ো-এনার্জি সহ পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উত্সগুলির মূলধারায় একীকরন সম্ভব হচ্ছে বৈদ্যুতিক যানের চার্জিং এর জন্য, ততদিন বৈদ্যুতিন পরিবহন মাধ্যম – প্রচলিত ICE (আইসিই) চালিত পরিবহন নেটওয়ার্কের পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসাবে গণ্য হবে না।
গবেষকদের একাংশ বৈদ্যুতিক যানবাহনের পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা নির্দেশ করে উপরোক্ত যুক্তি দেওয়া সত্ত্বেও- একথা অনস্বীকার্য যে বায়ু এবং শব্দ দূষণ হ্রাস করার ক্ষেত্রে এইধরণের যানের জীবনচক্রের সুবিধাগুলি দীর্ঘমেয়াদে তাদের পরোক্ষ দূষণের চেয়ে অনেক বেশি, যেকারণে বিভিন্ন দেশ জ্বালানী-ভিত্তিক যানবাহনগুলির বিদ্যুতায়নে এতো আগ্রহী।।
তবে বৈদ্যুতিক যানবাহনকে ‘জিরো এমিশন ভেহিকেলস’ এবং ‘জলবায়ু পরিবর্তনের একমাত্র সমাধান’ হিসেবে চিহ্নিত করা ততক্ষণ অবধি সঠিক হবে না, যতক্ষণ পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎস দ্বারা এই পরিবহণ পরিষেবাকে কার্যকরী করা সম্ভব হচ্ছে।
অন্যথায়, এই বিপণন কৌশলটি Greenwashing (গ্রীনওয়াশিং) এর সমতুল্য হিসেবে গণ্য হবে – যেখানে একটি সংস্থার পণ্য, লক্ষ্য এবং নীতিসবুজায়নের প্রাথমিক ধারাগুলি সমর্থন না করা সত্ত্বেও পরিবেশ বান্ধব হিসেবে স্বীকৃত হয়।
বৈদ্যুতিক যানবাহনে পুনর্নবীকরণ শক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি, ব্যাটারির পুনঃব্যবহার এবং সুপরিকল্পিত পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের সাহায্যে ব্যাটারি উৎপাদন প্রক্রিয়া উদ্ভূত কার্বনের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। যেহেতু ব্যাটারীর পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে মুনাফা একটি বড় বাধা, সেহেতু পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রযুক্তি এবং ব্যবসায়িক মডেলগুলি জোরদার করা সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও, বাধ্যতামূলকভাবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রীর পুনরুদ্ধার এবং লক্ষ্যমাত্রা চিন্হিত করা হ’লে, সমস্ত মূল ব্যাটারির উপকরণগুলির কার্যকর পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। অন্যদিকে, দেশের অভ্যন্তরীণ খনিজ ভান্ডার থেকে ব্যাটারী উৎপাদনের কাঁচামাল সহজলভ্য হলে, তাতে কার্বন ফুটপ্রিন্টও হ্রাস পাবে। এছাড়াও, আশা করা যায়, ভারতের ক্রমবর্ধমান পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা, ব্যাটারি বিনিময় (swapping) নীতি এবং উদ্ভাবনী, জলবায়ু–বান্ধব ও আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কিত আসন্ন নীতিগুলির ফলে, দেশে বৈদ্যুতিক যানবাহন পরিষেবার স্থিতিশীল এক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে ভবিষ্যতে।
সুচরিতা ভট্টাচার্য, পলিসি এনালিস্ট, কাটস্ ইন্টারন্যাশনাল
বৈশালী লোধ চৌধুরী, রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, কাটস্ ইন্টারন্যাশনাল