সারা পৃথিবী আজ ভয়ঙ্কর এক সমস্যার মুখোমুখি, মানুষ আজ ঘরবন্দি, এক অতি ক্ষুদ্র অণুজীবের কারণে। সারা বাংলাদেশ আজ স্তব্ধ, রাস্তাঘাট শুনশান, ব্যবসা বন্ধ, কর্মহীন মানুষ; দেশ জুড়ে চলছে লকডাউন। এর মাঝেই আজ সেই বিশেষ দিন, যে দিনটা প্রত্যেক বছর পালিত হয় শুধুই শ্রমিকদের দিন হিসেবে। তাঁদের সারা বছর কাটে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। একটি দিন সেই কাজ থেকে ছুটির দিন। এই সময়ে অবশ্য প্রতিদিনই তাঁদের কাছে কর্মহীন, বেকার হয়ে ঘরে বসে থাকার দিন।
১লা মে মহান ‘মে দিবস’। বিশ্বের শ্রমজীবি মানুষের আন্দোলনের ইতিহাসে এক চিরভাস্কর দিন। সকলকে জানাচ্ছি মে দিবসের সংগ্রামী শুভেচ্ছা । সেই সাথে স্মরণ করছি মে দিবস তথা শ্রমিক আন্দোলনের সেইসব মানুষদের যাঁরা বিশ্ব শ্রমিক সমাজের কল্যানে ১৮৮৬ সালের ১লা মে নিজেদের আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তাঁদের জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলী। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমাজের অধিকার আদায় এবং মর্যাদা রক্ষার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বের সকল মেহনতী জনতা আজকের এই দিনটি “আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’’ হিসাবে পালন করে আসছে। তাই এ দিনটি নিয়ে শ্রমিক স্বার্থের দিকে দৃষ্টি দিয়ে আমার আজকের বিশেষ এই লেখনী ।
শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের মাঝে আত্মসচেতনতার যে দীপশিখা প্রজ্বলিত হয়েছে, তার পেছনে ন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ভূমিকা ও অবদান অনেক। মে মাসের এক তারিখ হলো আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মহান মে দিবস।নানাবিধ উপাধিতে আজকের দিনটিতে এই দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় । মে দিবসকে বলা হয়–আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস । তাছাড়া ও এ দিবসটি–আন্তর্জাতিক শ্রমিক হত্যা দিবস, লেবার ডে, ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কার ডে ইত্যাদি মেহনতি জনতার আন্তর্জাতিক সংহতি ও সংগামের স্মৃতিস্মারক এই দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবি মানুষের অধিকার আদায়ের দিন এ দিবস
বিশ্বের অনেক দেশে এ দিবস বেশ সাড়ম্বরে পালিত হয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক আনন্দ-বেদনার যুগপৎ সম্মিলনের দিন। এ দিনে স্বীকৃতি পেয়েছে শ্রমজীবি মানুষের ন্যায্য অধিকারের দিকটি। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনবদ্য শ্রেণী-চেতনা ও ইতিহাস। কয়েকজন শ্রমিকের আত্মত্যাগে রচিত হয়েছে শ্রমিকের ন্যায্য মানবিকাধিকার ও সংগ্রামের এক হিরণ্ময় মাইলফলক। শ্রমজীবি মানুষ শুধু তাদের কার্যসময় সম্পর্কিত অধিকার পান নি; পেয়েছেন মানুষ হিসেবে মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং উপলব্ধি। নতুনকে চ্যালেঞ্জ রূপে গ্রহণের অনুপ্রেরণা। এ দিবস এলে তাঁরা আবার নতুন করে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেন। এ দিবস উদযাপনের গণজোয়ার আর কোরাস-ধ্বনিতে তাঁদের আত্মমর্যাদা ও অধিকার প্রতিধ্বনিত হয়ে দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে যায়। শ্রমজীবি মানুষের কর্ম প্রেরণা ও বেঁচে থাকার ন্যায্য-হিস্যা নিয়ে তাঁরা কথা বলেন। তাঁদের প্ররিশ্রমের সময় কতটুকু হবে, মজুরির পরিমাণ কত, অবসর, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়। দিকনির্দেশনার পথ খুঁজে পায়। বিগত দিনের সকল শোষণ বঞ্চনা, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং তার প্রেক্ষিতে কি করা যায় ইত্যাদি পরস্পরের মধ্যে শেয়ারিং হয়। সিদ্ধান্ত হয় নতুনের। শপথ ধ্বনিত হয় একাত্মতার।
মে দিবসের ঐতিহাসিক পটভূমি ও গুরুত্ব অনেক যেমনভাবে এর কাহিনী বেদনাবিঁধুর। সে কাহিনী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে। আগামী দিনগুলোতেও এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। মানুষের পৃথিবীতে যেকোনো ইতিহাস নানান শাসন-শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস। আন্তর্জাতিক শ্রম দিবসের ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে দেশে দেশে প্রায় একইরকম ঘটনাক্রম বা ইতিহাস থাকলেও মে দিবসের ইতিহাস আমেরিকার পটভূমিতে সৃষ্টি হয়। আর তা অনেক আগে থেকে। দেশটিতে শ্রমজীবি মানুষের সর্বপ্রথম সংঘ বা সমাজ গঠিত হতে শুরু করে ১৬৪০ সালে। ১৬৪৮ সালে বোস্টনে জুতা ও পিপা তৈরি শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকেরা সাংগঠনিকভাবে একত্রিত হন। ১৭০০ সাল ও তৎপরবর্তী সময়ে অন্যান্য পেশাজীবি শ্রমিকেরা বিভিন্ন সমাজ ও সংগঠন গড়ে তুলতে থাকেন। ১৭৭৬ সালে কার্পেন্টার হলে স্বাধীনতার ঘোষনা ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৭৯০ সালে রোহড দ্বীপের পোওটাকেট এলাকায় প্রথম বস্ত্র মিল প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে নিয়োজিত হয় ১২ বছরের কম বয়স্ক শিশু শ্রমিকেরা। ১৭৮০ থেকে ১৮০০ সাল শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে নানা বিষয়ে বিভিন্ন মতানৈক্যের ইতিহাস। এই দাবিদাওয়া, প্রতিবাদ এবং কাজ বন্ধ করে দেয়ার আন্দোলন ব্যাপৃত থাকে জুতা প্রস্তুতকারি শ্রমিক, ছুতার ও মুদ্রন শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের মাঝে।
অধিকাংশ শিল্প মিল কারখানায় কাজের পরিবেশ ও পরিস্থিতি ছিল অস্বাস্থ্যকর, ঝুঁকিপূর্ণ ও ভয়াবহ। স্বাস্থ্য ও জীবন মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল নিত্যসঙ্গী। কাজ করতে হতো ১০ থেকে ১৬ ঘন্টা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৮ ঘন্টার অধিক। ১৮২০ সাল ও তৎপরবর্তী সময়ে শিল্প কারখানার শ্রমিকেরা সাংগঠনিকভাবে একত্রিত হয়ে শক্তি সঞ্চয়ের বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেন, যার সূত্রপাত হয় নারী শ্রমিকের সংগঠনের মধ্য দিয়ে। এর ঠিক সাত বছরের মাথায় ফিলাডেলফিয়ায় শহর ব্যাপী শ্রমিক পরিষদ গঠিত হয়। ১৮৪৫ সালে সারা বাগ্লের নেতৃত্বে বিভিন্ন তুলা শিল্পে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ, স্যানিটেশন ও কার্যসময় নিয়ে ম্যাচাচুসেস্ট’এ দি ফিমেল লেবার রিফর্ম এসোসিয়েশন গঠিত হয়ে কার্যক্রম শুরু করে। তখন কার্যসময় ছিল ১২ থেকে ১৩ ঘন্টা এবং অন্যান্য বক্তব্যের সঙ্গে সংগঠনটির দাবি ছিল কার্যসময় ১০ ঘন্টায় নির্ধারণ করা।
১৮৬০ সালে নিউ ইংল্যান্ডে জুতা তৈরি শিল্পে নিয়োজিত ২০ সহস্রাধিক শ্রমিক দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে খুব সফলভাবে ধর্মঘট করেন। ১৮৬৮ সালে আমেরিকার যুক্তরাস্ট্রীয় আইনসভায় শ্রমিকদের কার্যসময় আট ঘন্টায় নির্ধারনের আইন পাশ হয় যা শুধুমাত্র সরকারি শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য হয়। বেসরকারি শিল্প-মিল-কারখানার ক্ষেত্রে অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি। ১৮৮১ সালে জর্জিয়া-আটল্যান্টায় ৩ সহস্রাধিক কৃষ্ণাঙ্গ নারী শ্রমিক, যারা লন্ড্রি শিল্পের কাজে নিয়োজিত এক বৃহৎ এবং সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরের বছর নিউইয়র্কে প্রথমবারের মতো শ্রমিক দিবস উদযাপিত হয়।
সংগঠিত হওয়ার ক্রম ইতিহাস ও দীর্ঘ আন্দোলনের পর্যায় অতিক্রম করেও শ্রমিকদের মানুষের মতো কাজ করার পরিবেশ, নিরাপত্তা, উপযুক্ত কার্যসময় ও মজুরি যথার্থভাবে অর্জিত হয় নি। সেই বিষয় ও তার কাহিনী লেখক Upton Sinclair তাঁর The Jungle-এ এবং Jack London Iron Hill -এ বইয়ে তুলে ধরেছেন। সেই লেখা থেকে শ্রমিকের দিনযাপন, জীবন ও আত্মত্যাগের বিষয় জানা যায়। ন্যায্য অধিকার ও মানুষের মতো বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে এই কাহিনী শ্রমিকদের মানসিকভাবেও উদ্দীপ্ত করেছে। শ্রমিকদের এই ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলো শিল্প মালিক দ্বারা বিভিন্নভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। আন্দোলন পদদলিত হয়েছে।
নিষ্পেষনের যাঁতাকলে পড়ে অনেক শ্রমিকের বলিদান হয়েছে। এ সময়ে শ্রম অধিকার ও মালিকানা চেতনার বিষয়টি রাজনৈতিক দর্শন ও মতবাদে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। আবার বলা যায়, নতুন রাজনৈতিক মতাদর্শ শ্রমিক আন্দোলনের বিষয়টিকে একটি পরিবর্তন ও পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে অপরিহার্যভাবে উৎসাহিত করে। সমাজ কাঠামো, সম্পত্তি চেতনা, মালিক বা পুজিপতি শ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণী এবং বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন ও সংঘাত থেকে মুক্তি এবং সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থার অগ্রসরমানতার লক্ষ্যে বঞ্চিত শ্রেণী নতুন কিছু পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কেননা সমাজতন্ত্র নতুন ও আকর্ষণীয় মতবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। শ্রমজীবি মানুষের মনে মানুষের মতো বেঁচে থাকার স্বপ্ন ও প্রত্যাশার বীজ বপন করেছে। তাঁদের মধ্যে এই উপলব্ধি হতে শুরু করে যে, পুজিবাদ সম্পত্তি ও কলকারখানার মালিকানার কারণে মালিকগণকে আরাম-আয়েস ও বিলাসি জীবনযাপনের পথ করে দিয়েছে ঠিকই তবে সে সবের পেছনে রয়েছে শ্রমিকের অমানুষিক পরিশ্রম। কেননা মালিকগণ শ্রমিকের দ্বারা উৎপাদিত পণ্য ও সেবার বিনিময়ে যে লভ্যাংশ তার দ্বারা লালিত হচ্ছে। এটি অন্যায় এবং শোষণ-বঞ্চনার শুভংকরের হিসাব। এ এক অদ্ভুত চক্রজাল যা শ্রমিকের জীবন ও অস্তিত্বকে বঞ্চিত ও নিষ্পেষিত করে চলেছে। এ থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। প্রতি বছর হাজার হাজার শ্রমিক তাঁদের স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে অমানুষিক শ্রম দিয়ে নিজেদের আয়ু কমিয়ে ফেলছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। বৃদ্ধ বয়সে তাঁর কোনো কাজ করার ক্ষমতা থাকে না, সেক্ষেত্রে তাঁর কোনো সামাজিক নিরাপত্তাও নেই। সমাজতন্ত্রের অন্যতম প্রবক্তা কার্ল মাকর্স ও ফ্রেডারিক এ্যঙ্গেল’স তাই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে এই মতবাদের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার কথা শিল্প সমৃদ্ধ রাস্ট্রগুলোতে সংঘটিত হতে বলেছিলেন। কিন্তু চিহ্নিত রাস্ট্রগুলোতে তেমনভাবে পরিবর্তনের চমক দেখা না দিয়ে তা বিকশিত হয় কৃষি ভিত্তিক রাশিয়াতে। পরবর্তী সময়ে সমাজতন্ত্র মতবাদ সেখানে আর চলমান থাকে নি। সে আর এক অন্য প্রসঙ্গ। তবে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র মতবাদ অনেকখানি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল বলে প্রমুখ দার্শনিকেরা বলে থাকেন। অন্যদিকে শ্রমিকদের আন্দোলনকে পুজিবাদী সমাজব্যস্থার কর্ণধারেরা দুস্কৃতিকারী ও নৈরাজ্যবাদী বলে গালাগাল দিয়ে গেছেন। কঠোর হাতে দমন করার চেষ্টা করেছেন। যখন শ্রমিকেরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাঁদের ন্যায্য অধিকার ও দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছেন তখন তা দমন করার জন্য শুরু হয় সুকঠিন সুকৌশল ষড়যন্ত্র জাল।
১৮৮৬ সালে মার্চে জেয় গ্লোউড মালিকানাধীন ইউনিয়ন প্যাসিফিক এ্যন্ড মিশৌরি প্যাসিফিকের প্রায় দুই লক্ষাধিক শ্রমিক ধর্মঘটে চলে গেলেন। অন্যান্য শিল্প-কলকারখানার শ্রমিকেরাও আন্দোলনে গেছেন। মে মাসে এক তারিখ। আমেরিকার প্রায় ১৩ হাজার মিল-কারখানার তিন লক্ষাধিক শ্রমিক কাজের সময় আট ঘন্টা নির্ধারন, মজুরি বৃদ্ধি, পরিবেশ উন্নয়ন ইত্যাদি দাবিতে নানান ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কোয়ারে একত্রিত হয়েছেন। ধর্মঘট চলছে। কাজ বন্ধ। তাঁদের হাতে হাতে নানান ব্যানারে লেখা: বিলাসী অলস জীবন নিপাত যাক, প্রাসাদে চির অশান্তি, কুড়েঘরেই শান্তি, কার্যসময় আট ঘন্টা মানতে হবে, শুকনো ব্যালটের চেয়ে এক পাউন্ড ডায়নামাইট শ্রেয়, ইত্যাদি। তাঁরা প্যারেড করছেন, বাদ্য বাজছে। প্রায় দশ হাজার শ্রমিক তাঁদের কাজের মধ্যে যে নানান বঞ্চনা তা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করছেন। দৃশ্যাবলী তুলে ধরছেন যাতে সকলে আরও উজ্জীবিত হয়ে চলেছেন। তাঁদের মধ্যে একতা আরও দৃঢ় হচ্ছে।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকা ও শিল্পমালিক অবস্থা সাংঘর্ষিক হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যা তখনও সত্য হয় নি। অথচ শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে দমন করা হয় বর্বর পন্থায়।শ্রমিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকের নাম ঘরে ঘরে আলোচিত হতে শুরু করেছে। এঁরা হলেন এ্যলবার্ট পারসন, যোহান ম্যোস্ট, অগাস্ট স্পাইস এবং ল্যুইস লিং। আরও অনেক শ্রমিক কাজে যোগদান বন্ধ করে আন্দোলনে অংশ নিতে থাকেন। পরবর্তী দুই দিন পরিবেশ শান্ত ও থমথমে। তিন তারিখে ম্যাককরমিক রিপার ওয়ার্কস শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এই শিল্প কারখানাটিতে বিগত ছয় মাস ধরে গোলমাল চলছিল।
মালিক কর্তৃপক্ষের সশস্ত্র এজেন্ট ও পুলিশেরা শ্রমিকদের নানাভাবে উত্যক্ত করে আসছিল। তাঁদের পিটুনি দেয়া হচ্ছিল। শ্রমিকগণ এর প্রতিবাদে ম্যাককরমিক রিপার ওয়ার্কস শিল্প এলাকা চত্বরের কাছাকাছি জায়গায় যখন সভা সমাবেশ থেকে বক্তৃতা করছেন তখন মালিক কর্তৃপক্ষের এজেন্ট ও পুলিশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করে। শ্রমিকেরা তার প্রতিবাদ করেন ও তাঁদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অধিকার জানান। অবশেষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। শ্রমিকেরা পাথরের টুকরো দিয়ে পিকেটিং করেন যেখানে পুলিশ তার জবাব দেয় গুলি করে। ফলে দুজন শ্রমিক মারা যান ও অসংখ্য আহত হন।পরের দিন খুব স্বল্প সময়ের নোটিশে হে মার্কেট স্কোয়ারে একটি প্রতিবাদ সভার আহ্বান করা হয়। সেদিন আবহাওয়া তেমন ভালো ছিল না। তবুও আগের দিন যেখানে তিন হাজারের মতো শ্রমিক জমায়েত হয়েছিল সেখানে দশ হাজারের উপর শ্রমিক যোগদান করেন। এ সভায় শুধুমাত্র শ্রমিক নন, তাঁদের পরিবারবর্গ ও সন্তানেরা যোগ দেন। এমন কি শিকাগো শহরের মেয়র নিজে উপস্থিত থাকেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি সাক্ষ্য দেন যে, পরিবেশ অত্যন্ত শান্ত ছিল এবং সহনীয় আলোচনা বক্তৃতা চলছিল। আলোচনা চলছে। এমনসময় শ্রমিকদের মধ্যে থাকা দুজন গোয়েন্দা পুলিশের দিকে এগিয়ে যায় এবং বক্তৃতা উস্কানিমূলক বলে রিপোর্ট করেন। ফলে পুলিশ সভা পণ্ড করার জন্য শক্তি প্রয়োগ শুরু করে। এসময় শ্রমিকদের মাঝখানে কোত্থেকে বোমা এসে বিস্ফোরিত হয়। প্রাণভয়ে আতঙ্কিত লোকজন পালাতে থাকে। পুলিশ শ্রমিকের উপর সরাসরি গুলি ছোড়া শুরু করে। এতে কত নিরীহ লোকের মৃত্যু হয় তার সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। তবে বলা হয়ে থাকে, শ্রমিক বা সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে সাত কিংবা আট জন নিহত এবং চল্লিশ জনেরও অধিক আহত হয়েছেন। অন্যদিকে একজন পুলিশ ঘটনাস্থলে ও সাতজন পরবর্তী সপ্তাহে মধ্যে মারা যায় বলে দাবী করা হয়।
পরবর্তীতে বোমা বিস্ফোরণে একজন পুলিশের মৃত্যু ও অন্যান্য পুলিশের আহতের অবস্থা প্রমাণীত হয়। যে সকল পুলিশ আহত হন তা তাদের নিজেদের ভুল গুলি চালনার ফলে হয়েছেন বলে নির্দেশিত হয়। বোমা নিক্ষেপকারীকে সনাক্ত করা যায় নি। তবে এই ঘটনার জন্য শ্রমিক নেতাদের মধ্য থেকে এ্যলবার্ট পারসন, অগাস্ট স্পাইস, স্যামুয়েল ফিলডেন, অস্কার নিব্, মাইকেল শোয়াব, জর্জ ইগেল, এডলফ ফিশার এবং ল্যুইস লিংকে অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করা হয়। বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়। কেননা বিচারক বা জুরিবোর্ডের সদস্যগণ ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। এই মামলায় মাত্র তিনজন ব্যক্তি ওই ঘটনার সময়ে এইসব নেতাদের উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয়। ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর এক ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। সকল আপীল আবেদন ব্যর্থ হয়।
এ্যলবার্ট পারসন, অগাস্ট স্পাইস, জর্জ ইগেল এবং এডলফ ফিশারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ল্যুইস লিং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগের দিন বিচার কর্তৃপক্ষ ও এই প্রক্রিয়া ন্যায়সঙ্গত নয় প্রতিবাদে মুখের ভেতর বিস্ফোরক রেখে আত্মহত্যা করেন। দীর্ঘ ছয় বছর পর স্যামুয়েল ফিলডেন, অস্কার নিব্ এবং মাইকেল শোয়াব-এর ক্ষমা প্রার্থনা মঞ্জুর হয়।১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবার্র্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক-এর প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালের আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এরপরপরই ১৮৯৪ সালের মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আটঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবী আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজনের সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহবান জানানো হয়।
সেই সম্মেলনে “শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না খাকলে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে’র ১ তারিখে “বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার” সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেক দেশে শ্রমজীবী জনতা মে মাসের ১ তারিখকে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে পালনের দাবী জানায় এবং অনেক দেশেই এটা কার্যকরী হয়। দীর্ঘদিন ধরে সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিষ্ট এবং কিছু উগ্রবাদী সংগঠন তাদের দাবী জানানোর জন্য মে দিবসকে মুখ্য দিন হিসাবে বেছে নেয়। কোন কোন স্থানে শিকাগোর হে মার্কেটের আত্মত্যাগী শ্রমিকদের স্মরণে আগুনও জ্বালানো হয়ে থাকে। পূর্বতন সোভিয়েত রাষ্ট্র, চীন, কিউবাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। সে সব দেশে এমনকি এ উপলক্ষ্যে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়।১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু এই দিনটি জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন।বাংলাদেশেও ছুটি থাকে। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় এই, যে আমেরিকাতে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের জন্ম সেখানে এ দিবসে কোনো ছুটি নেই।আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিবেচনায় এনে জাতিসংঘ তার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা।
এটি শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, মানবাধিকার রক্ষা ও তাঁদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে অনেক নিয়মকানুন প্রণয়ন করেছে। এই সংস্থায় স্বাক্ষরকারী সকল রাস্ট্রেই মে দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী রাস্ট্রের অন্যতম একটি। অথচ দুঃখের বিষয়, এ সমাজে শ্রমিকেরা নানাভাবে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। মালিক ও শ্রমিক সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ক্ষেত্রের দিকে দৃষ্টি দিলে এর সত্যতা প্রতিভাত হয়। বিশ্লেষণ করলে এক নিদারুন পরিহাস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। বিশেষ করে বিড়ি কারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বেকারি, মটর পরিবহন, ইট ভাটা ইত্যাদিতে অসহায় দরিদ্র শ্রমিক খুব স্বল্প মজুরি দিনরাত কাজ করে চলেছে। পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় নারী শ্রমিক যথার্থ মজুরি পান না। উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওগুলোতে নানান কৌশলে কর্মচারিদের অতিরিক্ত পরিশ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের নিয়োজিত করা হয়েছে এক মানবেতর জীবনযাপনে। চাকুরি নিরাপত্তার বিষয়টিও উপেক্ষিত। সুষ্ঠু ও দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া নেই। শুধু তাই নয়, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাস্ট্র হওয়া সত্বেও রাস্ট্রীয়ভাবে শ্রমিক কর্মচারিদের জন্য দু-ধরনের নিয়ম প্রবর্তিত আছে। সরকারি কর্মচারিদের জন্য দুদিন ছুটি আর বেসরকারি কর্মচারিদের জন্য একদিন ছুটি। এ শুধু হাস্যকর নয়, লজ্জাকরও বটে।
আজ এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের লড়াই সবচেয়ে কঠিন। এই লড়াই জীবনে বেঁচে থাকার লড়াই। এই আর্থিক বিপর্যয়ের মুহূর্তে ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়েছেন বহু শ্রমজীবী মানুষ। পরিসংখ্যান বলছে করোনা পরবর্তী সময়ে কয়েক কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। তাদের জীবনে নেমে আসবে ভয়ঙ্কর কালো দিন।
করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জায়গা থেকে কাজ হারিয়ে দলে দলে ফিরে এসেছে বহু মানুষ। তাদের সেই অসহায় ছবি প্রতিনিয়ত ভেসে উঠছে সংবাদ মাধ্যমের পর্দায়। অনেকে আবার ফিরতে না পেরে আটকে রয়েছে বিভিন্ন জায়গায় । কোনওরকমে সামান্য সাহায্যে তাদের মুখে জুটছে আহার, সেটাও অনিশ্চিত, কারোর কারোর হয়তো সেটাও জুটছে না নিয়মিত।
আজ এই ভয়ঙ্কর সঙ্কটের সময় দেশের এই সব শ্রমিকদের যেন কাজ থেকে ছাঁটাই না করা হয়। কিন্তু বাস্তবটা উল্টো। ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে তাদের ভবিষ্যৎ আজ সম্পূর্ণই অনিশ্চিত।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে সারা দেশ কবে মুক্তি পাবে তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে দেশের প্রতিটি মানুষ। তবে একদিন না একদিন করোনা-ভীতি থেকে সারা দেশ মুক্ত হবে, আসবে আবার নতুন সকাল, কিন্তু এই শ্রমিকদের জীবনে যে আঁধার নেমে এসেছে সেটা তারা কাটিয়ে উঠবে কীভাবে! তাঁদের জীবন থেকে যদি কলকারখানা, হাতুড়ি পেটানোর আওয়াজ চলে যায়, তাহলে মে দিবস পালনের ওই মুষ্টিবদ্ধ হাত আর কখনও উপরে উঠবে না।
এই পরিস্থিতি কেটে গেলে সরকার যেন এই সব মানুষদের কথা একটু ভাবেন এটাই প্রার্থনা করি। এই শ্রমিকদের জন্য যেন কিছু বিকল্প রাস্তা ভাবা হয়। যে সব মানুষদের কাছে এই মানুষগুলো কাজ করছিলেন তাঁরাও যেন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যথাসম্ভব মানবিকতার হাত বাড়িয়ে সাহায্য করেন।
আমরা সকলে যেরকম একসঙ্গে থেকে এই করোনা-সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। সেরকমই সকলে সকলের পাশে থেকে এই মানুষগুলোরও কাজ ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। তবেই এই মানুষগুলো আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন। সমাজ দাঁড়াতে পারবে। আমরা পালন করতে পারব মে দিবস। মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে উঠবে। শ্রমদিবসের লড়াইও সার্থক হবে।
পরিশেষে আমি মনে করি শুধু শ্রমজীবী সমাজেরই নয়, সমাজের সকল শ্রেণীর নারী ও পুরুষের যেমন রয়েছে জীবিকার অধিকার তেমনি রয়েছে মনুষ্যত্ব অর্জনের অধিকার। সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের কর্তব্য অধীনস্তদের মাঝে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো। ন্যায়-অন্যায় বোধ, সততা ও উদারতা, ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা এবং বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার মতো মানবীয় গুণাবলির চর্চা এখন অপরিহার্য।শ্রমিক আন্দোলন রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের বাহন না হয়ে শ্রমিকদের প্রকৃত কল্যাণে ব্রতী হবে আজকের দিনে এটাই আমাদের কামনা হওয়া উচিত।সচেতনতার মাধ্যমেই মহান মে দিবসের শহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন সম্ভব। জয় হোক শ্রমজীবি মানুষের অমর হোক মহান মে দিবস।