নয়াদিল্লি: ভারতের পরাজয়ে বাংলাদেশের উল্লাস। কথাটা শুনতেও খারাপ, কাজ তো খারাপই। এই বিষয়টি নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে।
তসলিমা নাসরিন এর আগেও লিখেছেন, আবারো মুখ খুললেন বিষয়টি নিয়ে।
তসলিমা নাসরিন লিখেছেন:
“বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেখছি মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধিতা। অথচ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের জয়ী হওয়া সম্ভব ছিল না। ভারত সাহায্য করেছিল বলেই পাকিস্তানের শোষণ এবং নির্যাতন থেকে মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছে মানুষ।
তবে কী কারণে আজ বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম এমনই অকৃতজ্ঞ যে ভারত খেলায় হেরে গেলে তারা উৎসব করে? তারা কি জানে না স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের অবদান কী ছিল? পরাধীনতার শেকল থেকে ভারতই তো পূর্ব বাংলার মানুষকে মুক্তি দিয়েছিল!
আমি জানিনা ইস্কুলের ইতিহাস বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলতে গিয়ে ভারতের অবদান এবং আত্মত্যাগের কথা বলা হয় কি না। যদি না হয়ে থাকে, তাহলে কিভাবে নতুন প্রজন্ম জানবে তারা কী করে একটি স্বাধীন দেশ পেল! সম্প্রতি ইস্কুলের পাঠ্যবই থেকে হিন্দু কবি লেখকদের গল্প কবিতা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা হয়তো শিখেছে এভাবে হিন্দুদের বাতিল করে দিতে হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে দেখেছি ডানপন্থীরা অর্থাৎ ইসলামপন্থীরা ভারত বিরোধিতা করতো, যেহেতু ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অমুসলিম। একই সঙ্গে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে চীনঘেঁষা বামপন্থী আতেঁলরাও ভারত বিরোধিতা করতো । আমরা বেড়ে উঠেছি এমন ভারত-বিরোধী পরিবেশে।
১৯৭৫এর পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলো, আর লাগাতার ক্ষমতা দখল করলো দেশের মিলিটারি, তারা তাদের ক্ষমতাকে বৈধ করার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করলো আর ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করলো নিজেদের স্থূল স্বার্থে।
রাজনীতি এমনই দিকনিশানাহীন হয়ে পড়লো, যে, এক দল আরেক দলের ব্যাপারে জনগণকে বলতে লাগলো, আমাদের ভোট না দিয়ে ওদের ভোট দিলে ওরা ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবে দেশ। ভারতকে বানালো হল জুজু। এই জুজুর ভয় দেখানো হতে লাগলো দেশের মানুষকে। যে দল ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেবেনা বলে লোকের বিশ্বাস হতো, তাকেই লোকে ভোট দিত। ভয় এমনই ছিল যেন সামনে পেলে ভারত সবাইকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।
ভারত -পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলায় ভারতের পক্ষে থাকতো বাংলাদেশের হিন্দুরা এবং মুসলমান পরিবারের খুব অল্প সংখ্যক মুক্তচিন্তক, বাকি সবাই থাকতো পাকিস্তানের পক্ষে। তখন আশির দশক। ইন্টারনেটের যুগ নয়। নেট ঘেঁটে কারও এই তথ্য জোগাড় করা সম্ভব হতো না আদৌ বাংলাদেশ নামক দরিদ্র দেশটিকে কিনতে চায় কি না ভারত।
সে তখনকার কথা। কিন্তু এখনকার প্রজন্ম কী কারণে ভারত বিরোধী হয়ে উঠেছে? রাজনীতি বদলেছে । এখন ভারত বিরোধিতা রাজনৈতিক মঞ্চের প্রধান স্লোগান নয়, তবে কী কারণ এদের ভারত বিরোধিতার? আমি যেটা মনে করি, সেটা হলো, আজ তিরিশ বছর ধরে দেশব্যাপী সরকার এবং সব রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সব সংস্থা সংগঠন সাধারণ মানুষকে ইসলাম পালনের জন্য চাপ দিচ্ছে, ইন্ধন যোগাচ্ছে, মগজ ধোলাই করছে , দরকার না থাকলেও অগুনতি মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে দিচ্ছে ।
——-
হয়তো ন’ মাসে দেশ স্বাধীন হওয়া উচিত ছিল না। আরও যদি কয়েক বছর চলতো, আরও রক্ত যেত, তাহলে হয়তো মানুষ বুঝতো স্বাধীনতার অর্থ কী। যদি অতি সহজে হাতের মুঠোয় এসে যায় কাংখিত জিনিস , তাহলে হয়তো সেই জিনিসের মর্যাদা থাকে না, শত্রু কে আর মিত্র কে, তা নিয়ে বিভ্রান্তিও ঘোচে না। এক সময়ের একই দেশের, এখন প্রতিবেশি দেশের এমন দুঃখজনক পরাজয়ে সমব্যাথী না হয়ে যারা উল্লাস করছে, তাদের অসুখ বিসুখ হলে ঠিকই ভারতে চিকিৎসা নিতে যাবে, বিয়ের বা ঈদের বাজার করতে ভারতে না গেলে হবে না, ভারতের সিনেমা আর সিরিয়াল না দেখলে আরাম হবে না। ভারত থেকে মাছ মাংস আনাজপাতি না এলে যাদের দিনের খাবার রোচে না, তারাও বীভৎস উল্লাস করছে একই রক্তের, একই বর্ণের মানুষের পরাজয়ে। আসলে বাঙালি মুসলমানের রক্তে ঢুকে গেছে ভারত বিরোধিতা, একসময় রাজনীতিকরা ঢুকিয়েছিল, পরে ধর্ম এসে ঢুকিয়েছে। মগজধোলাই হওয়া ভিকটিমদের হয়তো করার কিছু নেই প্রতিবেশি মিত্র দেশের পরাজয়ে ‘পৈশাচিক উল্লাস’ করা ছাড়া”।