খোলা চোখে যা গভীরভাবে দেখা যায় না, সেই অদেখাকে চাক্ষুষ করতেই ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখেছিলেন। প্রকৃতি থেকে মানুষ সবকিছু বন্দি হয়েছে তাঁর ক্যামেরায়। স্রেফ নেশার টানেই নিজের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদটি নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন মাইলের পর মাইল। সময় কাটিয়েছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর।
কিন্তু এই অধ্যাবসায় যে তাঁকে এত বড় একটা স্বীকৃতি এনে দেবে, তা কখনও ভেবেছিলেন বাংলাদেশি চিত্রগ্রাহক আসাদ? মনে হয় না। এবার ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মতো আন্তর্জাতিক পত্রিকার প্রচ্ছদে উঠে এল হৃদয়ে তোলপাড় ফেলা আসাদের সেই ছবি ‘রোহিঙ্গা শিশুকে কোলে আঁকড়ে সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে মা’। প্রথম বাঙালি হিসেবে এই কৃতিত্বে দাগ কাটলেন কে এম আসাদ।
এ ছবি যতটা সমাদৃত হয়েছে বিশ্বজুড়ে, ছবির প্রেক্ষাপটের গল্পও কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়। সময়টা ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর।
বিশ্বজুড়ে রোহিঙ্গা সমস্যা তখন মধ্যগগনে। মায়ানমার থেকে ফি দিনই নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকছেন লক্ষ লক্ষ শরণার্থী। অসহায় মহিলারা সন্তানদের আঁকড়ে ধরে প্রাণের তাগিদে দেশ ছাড়ছেন। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে নৌকায় জোর করে চড়ে বসা, উত্তাল সমুদ্রে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি, এগুলো নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের বন্দর শহর কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলে শরণার্থীর স্রোত।
প্রতিবেশী দেশের এমন এক সংকটকাল গভীর থেকে বোঝার জন্য সেই ছবি ক্যামেরাবন্দি করতে চেয়েছিলেন কে এম আসাদ। দাঁড়িয়ে ছিলেন নাফ নদীর পাড়ে, শাহপরী দ্বীপের কাছে। শরণার্থী প্রবেশের সময়ে চোখ রেখেছিলেন লেন্সে। একটা মুহূর্ত চমকে দেয় তাঁকে। ভিতর থেকে আমূল নাড়িয়ে দেয় তাঁর আলোকচিত্রী সত্ত্বা।
দেখেন, এক মা তাঁর ছোট্ট ছেলেকে বুকে চেপে প্রাণভয়ে বাংলাদেশের প্রবেশের চেষ্টা করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ ঠাঁই মায়ের কোলে থেকেও সেই দুধের শিশুর চোখেমুখে কী ভয়, কী আতঙ্ক! মুহূর্তটি তুলে রাখেন আসাদ।
এই ছবিই কালক্রমে ছড়িয়ে পড়ে। নজরে আসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের। তিনিই ছবিটিকে প্রচ্ছদ করার কথা ভাবেন। যোগাযোগ করা হয় এম কে আসাদের সঙ্গে।
তবে ছবিটি কভার ফটো হিসেবে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নীতিগত কিছু সমস্যা দেখা দেয়। নিয়ম অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তির কভার ফটো ছাপার আগে তাঁদের অনুমতি নিতে হয়। সেই নিয়ম মেনে যে মা-শিশুর ছবি তোলা হয়েছিল, তাদের অনুমতি নেওয়ার কথা বলা হয়।
এতে আসাদ পালটা প্রশ্ন রাখেন, এত এত শরণার্থীর থেকে কি আলাদা করে মা-শিশুকে চিহ্নিত করা সম্ভব? এটি কোনও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছবি নয়, বরং মানবসংকটের একটা জ্বলন্ত দলিল হিসেবে ছবিটিকে দেখা হলেই, যথার্থ বিচার করা হয়।
এই যুক্তির সঙ্গে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সম্পাদকমণ্ডলী সহমত হন এবং আসাদের ছবিটি কভার ফটো হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বে।
প্রথম বাঙালি হিসেবে কে এম আসাদ আলোকচিত্রের খ্যাতির বৃত্তে এভাবে ঢুকে পড়লেন। নেশার সঙ্গে, মানবিকতার সঙ্গে।
সূত্র- সংবাদ প্রতিদিন