সুদীর্ঘ ৪০ বছর ধরে মানবতাবাদ; নারী-পুরুষের সমানাধিকারের পক্ষে লড়াই করা প্রখ্যাত লেখক তসলিমা নাসরিনকে ‘গুগল’ ঘেঁটে নারীবাদের শিক্ষা গ্রহণ করার পরামর্শ এআর রহমান কন্যার!
গান-বাজনা-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত মুক্ত মনস্ক একটি মেয়ে কী করে বোরখার আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখে? রহমানের কন্যা খাতিজা রহমানের বোরখা পরিধান নিয়ে তীব্র কটাক্ষ করেছিলেন তসলিমা।
নাসরিনসহ মুক্তমানসিকতাসম্পন্ন লোকেরা কখনো ধারণা করতে পারেন না পুরুষের কাম-লালসাপূর্ণ দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে নারীকে পর্দার আড়ালে অবস্থান করতে হবে।
মূর্খামির চূড়ান্ত এবং কুপমণ্ডুকতার এই বিষয়গুলো নিয়ে তসলিমা সারাটা জীবন সংগ্রাম করে চলেছেন। যাকে হতে হয়েছে দেশছাড়া। পৃথিবীর মেয়েদের জন্যে তাঁর সংগ্রাম; পৃথিবীর মানুষের জন্যে তাঁর সংগ্রাম। যেখানে মুসলমান নির্যাতিত হয় সেখানে তাঁদের পক্ষে অবস্থান করেন তিনি, যেখানে হিন্দু নির্যাতিত, সেখানে হিন্দুর পক্ষে। জাত-ধর্মে অবিশ্বাসী একটি মানুষ বিশ্বাস করেন কেবল মানবতাবাদে।
এআর রহমানের মেয়ের জবাবে লেখক তসলিমা ফের যথোপযুক্ত জবাব দিয়ে লিখেছেনঃ
“রে মূর্খের দল। তোদের কাছে কি সত্যিই মনে হয় বোরখা পরা মেয়েরা নারীবাদী? চল্লিশ বছর যাবত যে নারী সমানাধিকারের জন্য সংগ্রাম করছে, যে সংগ্রাম মোল্লাতন্ত্রকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে, তাই তারা খুনের ফতোয়া দিয়েছে, তার ফাঁসির দাবিতে লক্ষ লোকের মিছিল বের করেছে, দেশে দেশে পুরুষতান্ত্রিক সমাজও তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে, কী করে তাকে দেশছাড়া করবে, রাজ্যছাড়া করবে, ভ্যানিশ করবে। তাকে গুগল করে ‘সত্যিকার নারীবাদ’ শিখতে বললো এক বোরখাওয়ালি মেয়ে, আর এটাই চরম বিনোদনের বিষয় হয়ে উঠলো সারা উপমহাদেশে!”
“সকলে হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে কেমন চমৎকার উত্তর দিয়ে আমাকে ‘কাবু’ করা হলো এই বলে। যেন আমি মানবতার শত্রু, যেন মেয়েদের সমানাধিকারের জন্য আমার এতকালের লেখালেখি সব ভুল, যেন নারীবিরোধী ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করা আমার ভুল, যেন বোরখাওয়ালীরাই আসল নারীবাদী, যেন ইসলামই নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করে, যেন পুরুষের চার বিয়েই সঠিক, কোরান যে অবাধ্য নারীকে মারধর করতে বলে, সেটাই সত্যিকারের নারীবাদ। আমিই ভুল।”

লেখক নাসরিনের এই পোস্টে বহু মুক্তমনস্ক লোকেরা কমেন্ট করেছেন। তাঁরা সকলেই তসলিমার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন।
মানবজাতী; নারীজাতির জন্যে সবচাইতে নির্মম পরিহাস হলো পুরুষের ধর্ষণ; উগ্র কাম লালসা; আগ্রাসী মনোভাব প্রভৃতি থেকে বাঁচার জন্যে সেই পুরুষটিকে নয়, বরং ঢেকে রাখা হয় নারীকে। পায়ে শৃংখল পরানো হয় নারীকে। নির্যাতন করা হয় নারীকে। কিন্তু সে নারী যতই পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখুন না কেন; ধর্ষণটাও কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁকেই করা হয়/ হতে হয়। যা দিনের পর দিন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এ কথা তসলিমা নাসরিন বারংবার, বহুভাবে লেখায়, ভাষণে বলেছেন; সাম্প্রতিক কালেও বলে চলেছেন।
পুরুষের জন্যে নারীর নিজেকে কেন লুকিয়ে রাখতে হবে? আপত্তির মূল কেন্দ্র সেখানেই। আবার সে বিকৃতমনস্ক পুরুষই তো ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে নারীকে! তাহলে???
ঘটনার সূত্রপাত গত ১১ ফেব্রুয়ারি। টুইটারে খাতিজার বোরখা পরিহিত ছবি পোস্ট করেছিলেন তসলিমা। ক্যাপশনে লেখেন, “আমি এ আর রহমানের গান খুবই ভালবাসি। কিন্তু যখনই তাঁর মেয়েকে আমি দেখি, দমবন্ধ হয়ে যায় আমার। একটি সাংস্কৃতিকমনস্ক পরিবারের শিক্ষিত মেয়েরও এত সহজে মগজধোলাই করা যেতে পারে!”
এর দু-দিন পর তেঁতে ওঠেন খাতিজা। তিনি লেখেন, “মাত্র এক বছর যেতে না যেতেই আবারও সেই টপিক। এই দেশে এত কিছু হচ্ছে, কিন্তু একজন মহিলা স্বেচ্ছায় কী পরবেন, কী পরবেন না, তা নিয়ে সবার মাথাব্যথা। প্রিয় তসলিমা নাসরিন, আমি দুঃখিত, আমার পোশাকের জন্য আপনার দমবন্ধ হয়ে আসে বলে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা হয় না। আমি যা করছি, সে জন্য আমি গর্বিত। নারীবাদের প্রকৃত অর্থ কী আপনি দয়া করে গুগ্ল করে দেখে নিন। অন্য মহিলাকে নীচ দেখিয়ে কখনও নারীবাদ প্রকৃতভাবে অনুসরণ করা যায় না। আর আমি নিজে কোনওদিন আপনাকে ব্যক্তিগত ভাবে ছবি পাঠিয়ে দেখতে বলিনি।’’
এরপর ফের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের লেখক নাসরিন তীক্ষ্ণ কটাক্ষ করে লিখেছেন, “বোরখাওয়ালীরা প্রায়ই এম্পাওয়ার শব্দটা ব্যবহার করে। তারা বলতে চায় তারা শক্তিময়ী, ক্ষমতাময়ী, স্বাধীন, এবং স্বনির্ভর। নিজের চেহারাটাই লুকিয়ে রাখতে হয় আর স্বাধীনতার বড়াই। কেন তারা শরীর আড়াল করে? কারণ তারা মনে করে পুরুষেরা সব কামুক, বর্বর, যৌন নির্যাতক, ধর্ষক; তাদের চুল আর ত্বক দেখা মাত্র পুরুষেরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, এর ফলে তারা এঁটো হয়ে যাবে। এঁটো হয়ে গেলে মুশকিল, কারণ স্বামী ফ্রেশ খাবে, এঁটো খাবে না। বোরখাওয়ালীরা নিজেদের খাদ্যবস্তু বলে বিশ্বাস করে।”