গত ১৩ সেপ্টেম্বর তারিখে জাতীয় নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা অনলাইনযোগে প্রকাশ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর প্রত্যেক সদস্য তাদের বর্তমান অবস্থা জানতে পেরেছেন।
কিন্তু সে তালিকায় নাম নেই দুশোরও অধিক শিলচরে বাস করা পতিতাদের!
চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি তালিকায় এত জন পতিতার নাম না আসার মূল কারণ হল, তাঁদের পরিবার কোনভাবেই প্রমাণপত্র হিসেবে লিগেসি ডাটা হাতে তুলে দেননি। যেহেতু সমাজের চোখে পতিতারা ঘৃণ্য, তাই চেষ্টা করেও তাঁরা পরিবারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেননি!
উল্লেখ্য, শিলচরের প্রেমতলা অঞ্চলের ‘১৪ নং গলি’ হচ্ছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবচাইতে বড় পতিতালয়। তাঁদের প্রত্যেকেই মানব পাচারের শিকার হয়ে এখানে এসেছেন।
যেহেতু তাঁরা পাচারের শিকার, তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের কাছে কোনপ্রকার বৈধ কাগজপত্র থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু আশ্চর্জনকভাবে পরিবারের লোকজনও তাঁদের সঙ্গে কোনরকম সম্পর্ক রাখতে আর রাজি নয়।
এনআরসি তালিকা থেকে বাদ যাওয়া পতিতাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছেন শিলচরের নারী আইনজীবির পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও-র মানুষ, যাঁরা সমাজে মহিলা সবলীকরণ এবং শক্তির পক্ষে কাজ করছেন। তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছেন পতিতাদের যেন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করা যায়। কতটুকু সফল হবেন, তাঁরা জানেন না।
জেলা আইন সেবা প্রাধিকরণ (কাছাড়) এবং সমাজ সেবক তুহিনা শর্মা নর্থ ইস্ট নাও নিউজকে জানিয়েছেন, “পতিতারা সমাজে যুগে যুগে অবাঞ্ছিত এবং অস্পৃশ্য হয়েই রয়েছেন। আমাদের সমাজ তাঁদের স্বাভাবিকভাবে কক্ষনো মেনে নিতে পারেনা। কিন্তু পতিতারাও আমাদের সমাজের অঙ্গ। আমরা ‘১৪ নং গলি’ নং গলিতে বহুবার যাতায়াত করেছি, তাঁদের মধ্যে এইডস এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দান করার জন্যে।”
তিনি আরো বলেন, “২০১৭ সালে কাছাড়ের জেলা আইন সেবা প্রাধিকরণের পক্ষ থেকে পতিতাদের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল, কিন্তু সে চেষ্টা অসফল হয়ে যায়। কারণ তাদের কাছে ব্যক্তিগত কোন কাগজ-পত্র নেই।”
শিলচরের আরো একখানা এনজিও ‘আশ্বাস’এর সদস্য অরুন্ধতী গুপ্ত নর্থ ইস্ট নাও-কে বলেন, “আমরা সকলেই সজাগ রয়েছি যে আমাদের শহরে একটি বিরাট বড় পতিতালয় আছে। এর জন্যে অসুবিধার সম্মুখীন না হওয়ার কথা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তাঁরা প্রত্যেকে মানব পাচারের শিকার। আমরা চেয়েছিলাম শিলচর থেকে এই পতিতালয় উঠিয়ে দেবার জন্যে। কিন্তু এনআরসি ইস্যুতে তাঁদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। আমরা তাঁদের ঘৃণা করতে পারি না কিংবা এই দুঃসময়ে তাঁদের তুলে দেয়া কোনমতেই যাবে না।”
নর্থ ইস্ট নাও চ্যানেলকে একজন পতিতা(নাম না করে) নিজ মুখে জানিয়েছেন, “আমরা কখনো জেনেশুনে এমন পেশায় আসতে চাইনি। আমাদের অত্যাচার করে এমন জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা চাইলেও এখান থেকে বেরোতে পারছি না। সমাজে আমরা গ্রহণীয় নই!”
একই ভাবে শোনা যায় তাঁদের মুখ থেকে, সত্যিই তাঁরা কতটা সমাজের মূল স্রোতে ফেরার জন্যে কিংবা নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করার জন্যে আকুল হয়ে পড়েছেন।
সংবাদ মাধ্যমে একজন বলেন, “আমরা সত্যিই এনআরসি’তে অ্যাপ্লাই করতে চাই। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ অফিসে ফর্ম জমা দেবার চেষ্টাও চালিয়েছে। কিন্তু আমাদের পরিবার আর আমাদের গ্রহণ করতে রাজি নয়। আমাদের সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে গেছে। আমরা বড্ড ভয়ে ভয়ে প্রতিটা দিন কাটাচ্ছি! হয়তো হঠাৎ কোন একদিন সরকার এসে আমাদের চিরতরে ভারত ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে যাবে, অথবা যেতে হবে ডিটেনশান ক্যাম্পে!”