“মানুষের পরিচয় হবে তার মনুষ্যত্ব দিয়ে, ধর্ম দিয়ে নয়। সেদিন কবে আসে কে জানে। তার আগে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হোক, মৌলবাদ আর সন্ত্রাস বন্ধ হোক।”
ভারত তার দরজা অত্যাচারিত হিন্দু তথা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্যে খোলা রেখেছে। এবার বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানেরও উচিৎ একই কার্য করা। আজীবন মানবতার পক্ষে লড়াই করে যাওয়া বাংলাদেশের লেখক তসলিমা নাসরিন নয়া দিল্লির হিংসাত্মক পরিস্থিতি নিয়ে এই খোলা বার্তা দিয়েছেন।
“বাংলাদেশ পাকিস্তানের অত্যাচারিত ভীত সন্ত্রস্ত হিন্দুদের জন্য ভারত তার উদার দরজা খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানেরও উচিত ভারতের অত্যাচারিত ভীত সন্ত্রস্ত মুসলমানের জন্য নিজেদের দরজা খুলে দেওয়া।”
ভারতের নয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন এবং পার্সি শরণার্থীদের নতুন জীবন প্রদান করা হবে।
৩ দেশে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার মানুষগুলোকে এভাবেই কোলে তুলে নিয়েছে ভারত।
তসলিমা নাসরিন জানাচ্ছেন, এবার একইরকমভাবে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানেরও উচিৎ ভারতের অত্যাচারিত মুসলমানদের কোলে তুলে নেওয়া, অন্তত ভারতের ভীত; সন্ত্রস্ত মুসলমানরা যদি দেশত্যাগ করতে চায় তাহলে।
তিনি লিখেছেন, এটি আপাতত। কারণ এটি মানুষ বাঁচানোর একটি নিদান হলেও মানুষের হিংসা রোধ করতে পারে না।
মানুষের হিংসা, দ্বেষ রোধ করতে পারে মানবতা। সত্যিকার মানবতা।
চারদিকে ধর্মের রাজনীতি ছড়িয়ে পড়ছে লকলকে শিখায় আগুনের মতো।
“সব ধর্মের, সব জাতের , সব বর্ণের , সব শ্রেণীর মানুষ যদি মিলে মিশে সুখে শান্তিতে বাস করতে পারতো, সবার মধ্যে যদি সহমর্মিতা হৃদ্যতা থাকতো।” “একে রোধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি ক্ষমতাহীন প্রভাব-প্রতাপহীন কিছু অসহায় নিরীহ মানুষ। আমাদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না।”
তিনি স্পষ্টভাবে লিখেছেন, “দিল্লির দাংগাবিধ্বস্ত এলাকা থেকে গত দুদিন মুসলমানরা ঘটিবাটি লেপ তোশক কাঁধে করে নিয়ে যখন পালাচ্ছিল, কেউ ওদের প্রশ্ন করেছিল, কোথায় যাচ্ছে তারা, তারা তখন জানে না কোথায় যাচ্ছে। ওরা যদি বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে যেতে চায়, আমার তখন মনে হচ্ছিল, দরজা খুলে দেওয়া উচিত।”
বহু মানুষ লেখকের এ কথার প্রতিবাদ করে বলেন, কেন মানুষকে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে? এ দেশ সকলের।
প্রত্যুত্তরে নারীবাদী লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি কখনোই কাউকে দেশ ছেড়ে পালানোর পক্ষে নন। তিনি মানবতার পক্ষে। তবে “কেউ যদি দেশত্যাগ করতে চায় তার সেই স্বাধীনতা থাকবে না কেন। ধনীদের সেই স্বাধীনতা আছে, গরিবদের নেই। পৃথিবীতে সবারই যে দেশে ইচ্ছে যাওয়ার,যেখানে ইচ্ছে বাস করার অধিকার থাকা উচিত।”
প্রসঙ্গত, দেশত্যাগের যন্ত্রণা কেমন, তা অন্তত নিজ দেশ থেকে ২৫ বছর ধরে নির্বাসিত লেখককে আর বোঝাতে হবে না। তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা গরিবের পক্ষে। মানবতার পক্ষে। সমস্ত ধর্মের উর্ধে উঠে সকলের সমানাধিকারের পক্ষে।
“ভালো হতো মানুষের সত্যিকার ধর্ম যদি মানবতা হতো। সব ধর্মের, সব জাতের , সব বর্ণের , সব শ্রেণীর মানুষ যদি মিলে মিশে সুখে শান্তিতে বাস করতে পারতো, সবার মধ্যে যদি সহমর্মিতা হৃদ্যতা থাকতো। কিন্তু বারবারই দেখছি ঘৃণা মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। অমানবতাই এখন ধর্মের অপর নাম। যারা ধর্মের উর্ধে উঠতে পেরেছে, তাদের মধ্যেই কিছুটা মানবতা দেখি। ধর্ম, ধর্মের রাজনীতি অরণ্যের আগুনের মতো বাড়ছে। একে রোধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি ক্ষমতাহীন প্রভাব-প্রতাপহীন কিছু অসহায় নিরীহ মানুষ। আমাদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
দিল্লির দাংগাবিধ্বস্ত এলাকা থেকে গত দুদিন মুসলমানরা ঘটিবাটি লেপ তোশক কাঁধে করে নিয়ে যখন পালাচ্ছিল, কেউ ওদের প্রশ্ন করেছিল, কোথায় যাচ্ছে তারা, তারা তখন জানে না কোথায় যাচ্ছে। ওরা যদি বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে যেতে চায়, আমার তখন মনে হচ্ছিল, দরজা খুলে দেওয়া উচিত।
ধর্মের মতো হাস্যকর কল্পকথা দিয়ে দেশ ভাগ করা, মানুষ ভাগ করা খুব অন্যায়। কিন্তু আপাতত কিছু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমরা ভাবতেই পারি দরজা খোলার কথা। ধনী হিন্দু বা ধনী মুসলমান তো নিরাপত্তার জন্য ইওরোপ বা আমেরিকায় চলে যায়। তখন তো কেউ প্রশ্ন করে না কেন যাচ্ছে! গরিবের তো প্রতিবেশিই সম্বল। ধর্মের কৃত্রিম কাঁটাতার ডিঙিয়ে যাওয়া শুধু। আসলে তো একই মাটির মানুষ সবাই।
কোনও একদিন ধর্ম যখন জীবনের মূখ্য কোনও বিষয় থাকবে না, ধর্মের রাজনীতিরও জনপ্রিয়তা নষ্ট হবে, তখন এই উপমহাদেশ, এই দক্ষিণ এশিয়া এক হবে নিশ্চয়ই। মানুষের পরিচয় হবে তার মনুষ্যত্ব দিয়ে, ধর্ম দিয়ে নয়। সেদিন কবে আসে কে জানে। তার আগে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হোক, মৌলবাদ আর সন্ত্রাস বন্ধ হোক।”