আমরা জানি হোয়ে প্রোটিন পাউডার অ্যাথলিটরা খুব ব্যবহার করেন। সোস্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই হোয়ে প্রোটিন খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এখন আপনার মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে হোয়ে প্রোটিন অ্যাথলিট বা যারা চর্বিহীন (lean) শক্তিশালী পেশীগঠিত শরীর গঠন করতে চান তারাই কি শুধুমাত্র হোয়ে প্রোটিন খাবেন? এটা কি সকলের জন্য ভালো? আপনি ভাবতে পারেন তুলনামূলক ভাবে যারা আরামপ্রদ জীবনযাপন করেন বা অল্পমাত্রায় এক্সারসাইজ করে তারাও কি হোয়ে প্রোটিন থেকে একই রকম উপকার পাবেন? আপনার সব প্রশ্নের উত্তর হল হ্যাঁ হোয়ে প্রোটিন খেলে সবরকম জীবনযাত্রার মানুষেরই উপকার হয়। যদি প্রতিদিনের খাবারের সঙ্গে পরিপূরক হিসাবে হোয়ে প্রোটিন পাউডার খেতে শুরু করেন, তাহলে অবিলম্বে আপনি আপনার সাস্থ্যের সার্বিক উন্নতি লক্ষ্য করতে পারবেন। এছাড়াও হোয়ে প্রোটিন অনেকরকম মারাত্মক রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
আসুন জেনে নিই হোয়ে প্রোটিন কি আর কিভাবেই বা হোয়ে প্রোটিন সাস্থ্যরক্ষায় সহায়তা করে।
হোয়ে প্রোটিন কি?
চীজ তৈরী করার সময় দুধ থেকে যে তরল পদার্থটি আলাদা হয়ে যায় সেটিকে হোয়ে বলে। এই তরলের প্রোটিন অংশটিকে হোয়ে প্রোটিন বলে।
আমরা সবাই জানি দুধকে কমপ্লীট বা স্বয়ংসম্পূর্ণ খাদ্য বলে। দুধে মূলত দুরকমের প্রোটিন থাকে: ক্যাসেইন (casein 80%) আর হোয়ে (whey 20%)l দুধের জলীয় অংশটিতে হোয়ে প্রোটিন থাকে। চীজ তৈরী করার সময় বা ছানা তৈরী করার সময় দুধের চর্বিজাতীয় (fatty) অংশটি ঘন হয়ে জমে যায় আর হোয়ে বাইপ্রডাক্ট হিসাবে আলাদা হয়ে যায়।
ইয়োগার্টের কাপ খুললে ওপরে যে জলীয় পদার্থটা ভাসতে দেখা যায় – ওটাই হোয়ে।
চীজ তৈরী করার সময় এই হোয়ে আলাদা করে নেওয়া হয়। তারপর অনেকরকম প্রসেসিং প্রক্রিয়ার পর এই হোয়ে প্রোটিন পাউডারের আকারে পরিণত হয়। হোয়ে প্রোটিন অনেকেই পরিপূরক খাদ্য (meal supplement), প্রোটিন বার অথবা শেক (shake) হিসাবে খেয়ে থাকি।
হোয়ে প্রোটিন কেন খেতে হয়?
উপযুক্ত রেজিসট্যান্স এক্সারসাইজ বা প্রতিরোধের ব্যায়ামের সঙ্গে সঠিক পরিমানে হোয়ে প্রোটিন খেলে শরীর কতরকম ভাবে উপকৃত হয় একে একে জেনে নিন।
- হোয়ে প্রোটিন পাউডার শরীরের ওজন কমিয়ে বি এম আই স্বাভাবিক রাখে।
হোয়ে প্রোটিন পাউডার (whey protein powder) খেলে অনেকক্ষণ পেট ভরা থাকে। ক্ষিদে পায় না। তাই মাঝে মাঝে স্ন্যাকস খাওয়ার ইচ্ছেও হয় না। তার ফলে শরীরে ক্যালরি গ্রহণ কম হয়। হোয়ে প্রোটিন শরীরের মেটাবলিজমের হারও বাড়িয়ে দেয়। এতে ক্যালরি বার্ন বেশী হয়। তাই শরীরের ওজনও কমে যায়। কিন্তু পেশীর ভর নিয়ন্ত্রনে থাকে।
নিয়মিত হোয়ে প্রোটিন খেলে বি এম আই (BMI) ঠিক রাখা যায়। বি এম আই বেশি হলে হার্টের অসুখ, উচ্চ রক্ত চাপ, টাইপ টু ডায়াবিটিস, আথ্র্রাইটিস,কিডনির অসুখ ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই বি এম আই নিয়ন্ত্রনে রাখা খুব জরুরি। বি এম আই ক্যালকুলেটরে (BMI Calculator) আপনি আপনার বি এম আই কত সেটা দেখে নিতে পারেন। বি এম আই= কেজি/ মিটার^2 এখানে- কেজি হল আপনার ওজন কেজিতে নেওয়া আর মিটার^2 হল আপনার উচ্চতা যত মিটার তার দ্বিগুণ।
ক্যালকুলেটরে সহজ এই অঙ্কটি করলে যে সংখ্যাটি পাবেন সেটাই আপনার বি এম আই।
নীচের এই ছকটি (table) দেখে মিলিয়ে নিতে পারেন আপনার বি এম আই কোন জায়গায় আছে।
বি এম আই(BMI) | পূর্বস্থিতি (Status) |
18 থেকে কম | কম ওজন (Underweight) |
18-25 | সাস্থসম্মত (Healthy) |
25-30 | বেশি ওজন (Overweight) |
30-35 | স্থূল (Obese) |
35-40 | গুরুতরভাবে স্থূল (Severely obese) |
40 থেকে বেশি | অসুস্থভাবে স্থূল (Morbidly obese) |
.
- টাইপ টু ডায়াবিটিসে হোয়ে প্রোটিন খুব উপকারী
টাইপ টু ডায়াবিটিসে রক্তে শর্করার মাত্রা খুব বেশি হয় আর ইনসুলিন কার্যক্ষম থাকে না। ইনসুলিন একধরনের হরমোন যা রক্তের মাধ্যমে কোষে পৌঁছনো শর্করার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। হোয়ে প্রোটিন ইনসুলিনের ক্ষরণ বাড়ায়। ফলে রক্তের শর্করা সুস্হ মাত্রায় থাকে। তাই দুপুরে ও রাতে অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবারের সঙ্গে হোয়ে প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট খেতে ডাক্তারবাবুরাও বলে থাকেন।
শরীরের ওজন বেশি হলে বা স্থূল হলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাাখা কঠিন হয়। শরীরে ইনসুলিনের ক্রিয়া চর্বির অনুর জন্য প্রতিহত হয়।আমরা জানি হোয়ে প্রোটিন খিদে কমিয়ে ওজন কমায়। এইভাবে হোয়ে প্রোটিন ডায়াবেটিস ম্যানেজমেন্টে সহায়তা করে। এই ডায়েট সুস্থ মানুষ ও টাইপ টু ডায়াবেটিক রোগী সবার জন্যই ভালো।হোয়ে প্রোটিন খেলে টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
- হার্টের সুস্হতার জন্য হোয়ে প্রোটিন কার্যকরী
দীর্ঘদিন ধরে হোয়ে প্রোটিন খেলে রক্তে হাই কোলেস্টেরল বিশেষ করে এল ডি এল বা খারাপ কোলেস্টেরল কমে যায়।
এল ডি এল শিরার (vein) দেওয়লে প্লাকের (plaque) আকারে জমে যায়। তাতে দেওয়াল শক্ত হয়ে যায়। শিরা সরু হয়ে যাওয়ার ফলে রক্তকে জোর দিয়ে যেতে হয়। এর ফলে উচ্চ রক্তচাপ হয়। যতটা প্রয়োজন ততটা রক্ত হার্টে পৌঁছয় না। এতে হার্টের পেশী অক্ষম হয়ে যায়। এই অবস্থা চলতে দিলে হার্ট ফেইলিয়র হয়।
প্লাক যদি খুলে বা ফেটে যায় তাহলে ব্লাডক্লট তৈরী হয়। এই ব্লাডক্লট রক্তের প্রবাহের সঙ্গে হার্টে পৌঁছে হার্ট অ্যাটাক করে।
হোয়ে প্রোটিন এল ডি এল আর ট্রাইগ্লিসারাইড দুটোই কমায়। এর ফলে হার্টের অসুখ হওয়ার প্রবনতা কমে আর হার্টও সুস্থ থাকে।
- হোয়ে প্রোটিন উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে
যাদের হাই ব্লাড প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ আছে তারাও হোয়ে প্রোটিন পাউডার খেলে উপকার পাবেন। কারণ হোয়ে প্রোটিনে ল্যাকটোকাইনিন নামক একরকমের বায়োঅ্যাকটিভ পেপটাইডস থাকে যা অতিরিক্ত উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
- হোয়ে প্রোটিন পাউডার শরীরের ইমিউনিটি বাড়ায়
হোয়ে প্রোটিন পাউডার গ্লুটাথিয়োন নামে একটা প্রয়োজনীয় অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট তৈরি করতে সাহায্য করে। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ফ্রি র্যাডিকলস ধ্বংস করে। ফ্রি র্যাডিকলস শরীরের পক্ষে বিপজ্জনক। এগুলি সুস্থ কোষ যেমন আপনার ইমিউনিটির কোষ থেকে ইলেকট্রন নিয়ে নেয়। এর ফলে কোষের ডি এন এ, প্রোটিন, আর কোষের ঝিল্লি নষ্ট হয়ে যায়। আপনার ইমিউনিটি কোষ কাজ করতে পারে না। হোয়ে প্রোটিন ফ্রি র্যাডিকলস কমিয়ে আপনার শরীরের প্রতিরক্ষা বাড়ায়।
- ইনফ্লেমেটরি বাওয়েল ডিজিজে উপকার হয়
ইনফ্লেমেটরি বাওয়েল ডিজিজ বা আই বি ডি একরকমের অসুখ। সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন পাকস্থলী ও অন্ত্রে প্রদাহ তৈরী করে। হোয়ে প্রোটিন এই সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিনের মাাত্রা কমিয়ে দেয়। এ ছাড়াও, হোয়ে প্রোটিন পাউডার আপনার অন্ত্রে ভালো ব্যাকটিরিয়ার সংখ্যা বাড়িয়ে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এইভাবে হোয়ে প্রোটিন পাউডার আই বি ডি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে।
- হোয়ে প্রোটিন পেশীকে শক্তিশালী করে
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পেশীভর (muscle mass) কমে, শরীরে চর্বি জমে। এর ফলে অনেক ক্রনিক অসুখ শরীরে বাসা বাঁধে। এই সময়ে তাই স্ট্রেন্থ ট্রেনিং আর উচ্চমাত্রার প্রোটিনযুক্ত খাবার বা প্রোটিন সাপ্লিমেন্টস খেলে পেশীভর বাড়িয়ে দেয়। হোয়ে প্রোটিন পাউডার শরীরে উচ্চ মানের প্রোটিনের জোগান দেয়।
হোয়ে প্রোটিনের ডোজ এবং কিভাবে ব্যবহার করবেন
হোয়ে প্রোটিন খুব সহজেই আপনার খাদ্যতালিকায় ঢুকিয়ে নিতে পারবেন।
এটি পাউডার হিসাবে পাওয়া যায়। তাই আপনি স্মুদি, ইয়োগার্ট বা দই এর সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন। দুধ বা জলের সঙ্গে মিশিয়েও হোয়ে প্রোটিন পাউডার খাওয়া যায়।
সাধারণত একজন ব্যক্তি প্রতিদিন 25 গ্রাম থেকে 50 গ্রাম (1 চামচ থেকে 2 চামচ) হোয়ে প্রোটিন খেতে পারেন। তবে বিভিন্ন প্যাকে বিভিন্ন ডোজ লেখা থাকে। সতর্ক ভাবে সেটা অবশ্যই পড়ে নেবেন।
একবার অবশ্যই আপনার ডাক্তারবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে নেবেন। কারণ আপনার বয়স, লিঙ্গ, বি এম আই, কার্যক্ষমতা, চিকিৎসাজনিত ইতিহাস ইত্যাদি নজরে রেখে আপনার ডাক্তারবাবু আপনার উপযোগী ডোজ নির্ধারণ করে দেবেন।
হোয়ে প্রোটিন এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
খুব বেশি পরিমানে প্রোটিন খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো না। তাহলে পাচন প্রক্রিয়ায় কিছু সমস্যা দেখা দেয়। যেমন –
- বমিভাব
- পেটব্যথা
- পেটফাঁপা
- পেটে খিল ধরা ভাব
- ডায়রিয়া
যদিও পরিমিত পরিমাণে হোয়ে প্রোটিন পাউডার খেলে অধিকাংশ মানুষেরই কোনরকম সমস্যা হয় না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে-
- যদি আপনার শরীর ল্যাকটোজ ইনটলারেন্ট হয় তাহলে আপনি ‘হোয়ে প্রোটিন কনসেনট্রেট’ এর পরিবর্তে ‘হোয়ে প্রোটিন হাইড্রোলাইসেট’ ব্যবহার করবেন।
- যদি আপনার কিডনি বা লিভারের কোনরকম অসুখ থাকে তাহলে আপনার ডাক্তারবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে হোয়ে প্রোটিন পাউডার খাবেন।
উপসংহার
হোয়ে প্রোটিন হল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, উচ্চমানের প্রোটিন যাতে প্রয়োজনীয় সবকটি অ্যামিনো অ্যাসিডই আছে। অ্যামিনো অ্যাসিড হল শরীর গঠনের বিল্ডিং ব্লক। উপরন্তু হোয়ে প্রোটিন খুব সহজপাচ্য, তাই শরীর অনায়াসেই এর অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো শোষণ করে নেয়।
এতক্ষণে আপনি হোয়ে প্রোটিনের সব রকমের উপকারিতা জেনে গেছেন। তাই আর দেরি না করে এখনই হোয়ে প্রোটিন পাউডার অর্ডার করে দিন।