‘পাল তোলা ওই নায়ের মাঝি/ভাটিয়ালি গায়/ঘোমটা পরা গাঁয়ের বধূ/শ্বশুরবাড়ি যায়। ও মাঝি ভাই ও মাঝি ভাই/কোন সে গাঁয়ে যাও/চলন বিলে মামার বাড়ি/আমায় নিয়ে যাও।’
গাঁয়ের বধূর এমন আকুতি হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশের নদী-বিলে নেই আর সেই মাঝি ভাইয়ের পালতোলা নৌকা। আছে শুধু সেসব সোনাঝরা দিনের স্মৃতি নিয়ে ছড়া-কবিতা।
আধুনিক নগর সভ্যতার যুগে যান্ত্রিক যানবাহনের ভারে পালতোলা নৌকা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। হাতেগোনা দু একটা চোখে পড়লেও তাদের নৌকায় আগের মতো আর মানুষ ওঠে না।
তবে এখন চলছে যান্ত্রিক সভ্যতা প্রসারের যুগ। আর জলেও লেগেছে পরির্বতনের হাওয়া।
জলে চলমান নৌকার শতকরা ৮০ ভাগই হচ্ছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। যাত্রী কিংবা মালামাল পরিবহনের অপেক্ষায় ঘাটে-ঘাটে বাঁধা থাকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। শুন-শান নদীতে ভটভট আওয়াজ করে প্রচণ্ড ঢেউ তুলে চলাচল করে ওই সব নৌকা। ইঞ্জিনচালিত নৌকার বিকট আওয়াজে নদী কিংবা হাওরের দু’পাড়ের গ্রামবাসীর কান ঝালাপালা। আর এগুলো চলার ফলে সৃষ্ট ঢেউয়ের আঘাতে নদীর দু’পাড়ের গ্রামগুলোও ভয়াবহ ভাঙনে হুমকির সম্মুখীন।
ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে সাত শতাধিক মাঝি নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বুড়িগঙ্গা নদীর সদরঘাটের খেয়া নৌকার মাঝি আব্দুস শহীদ। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে তাঁর বাড়ি। ২০ বছর ধরে তিনি সদরঘাটে খেয়া পারাপার করছেন। দীর্ঘদিন ধরে সকাল-সন্ধ্যা মানুষ পারাপার করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যেন বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন আব্দুস শহীদ।
সারাদিন নৌকা বেয়ে ৩/৪শ’ টাকা আয় করেন মাঝি আব্দুস শহীদ। এর মধ্যে থেকে প্রতিদিন নৌকা খরচ ও চাঁদা বাবদ গুণতে হয় ১৬০ টাকা। সদরঘাটে তিনবেলা খেয়ে সামান্য টাকা নিয়ে ঘরে ফেরেন তিনি। এতে করে ছেলে মেয়েদের নিয়ে সংসার চলে টানা-পড়েনের মধ্য দিয়ে। তারপরেও মাঝি আব্দুস শহীদ মনের আনন্দে গান খেয়ে খেয়া পারাপার করছেন।
শুধু আব্দুস শহীদ দুঃসহ জীবনের গল্পই এমন নয়, সদরঘাটে মাঝিদের বেশির ভাগেরই জীবনচিত্র একই রকমের। আয় কমছে সবার। হাসি নেই মুখে। আছে হতাশার সুর।
জীবন সংগ্রামে প্রাণান্তকর চেষ্টা চলছে। চলছে রাত-দিন টিকে থাকার লড়াই। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নৌকা চলে জীবন চলে না তাঁদের।
এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, জীবিকার তাগিদে সদরঘাট-ওয়েজঘাট থেকে তেলঘাট, রহমত আলীর ঘাট ও কালীগঞ্জ চরঘাট পর্যন্ত প্রতিদিন ভোর থেকে বুড়িগঙ্গায় প্রায় ৭শ’ নৌকা ভাসান মাঝিরা। নানা সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা। অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা লগি-বৈঠার ভালোবাসা টিকিয়ে রেখেছেন।
আব্দুস শহীদ জানান, পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় অভাবের তাড়নায় নেমে পড়েন এ কাজে। এতে সহযোগিতা করেন তার মামা। তার হাত ধরে একটি ভাড়া নৌকা চালানো শুরু করেন। সেই সময়ে নৌকা ভাড়া লাগত একদিনে ১০ টাকা করে। এখন সেটি ৮০ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। সদরঘাট কর্তৃপক্ষকে খাজনা দিতে হয় আরও ৮০ টাকা এবং রাতে নৌকা পাহারা বাবদ দিতে হয় ২০ টাকা। সব মিলে এখন দুর্বিষহ দিন যাচ্ছে আব্দুস শহীদের।
তাঁর আক্ষেপ, ‘আগে ভালো ছিলাম, এখন ভালো নেই। নৌকা বাদ দিয়ে এখন বুড়িগঙ্গায় ট্রলার নামানোর ষড়যন্ত্র চলছে। নৌকা চালানোয় লাভ থেকে লোকসান বেশি। দৈনিক ১৮ ঘণ্টা নৌকা বাইয়ে ৫০০ টাকার বেশি আয় হয় না। দুঃখ-দুর্দশার এই দিনে অন্য কিছু করারও বয়স নেই। তাই এখানে বাধ্য হয়ে মাঝির কাজ করছি। আমরা এখন অবহেলিত দিন যাপন করছি।’