“আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;” ।
আহা! এমনই অসাধারণভাবে অসাধারণ ভঙ্গিমায় হৃদয়ের কথাগুলো যিনি বাঙময় করে গেছেন সৃষ্টির মাধ্যমে, তিনি জীবনানন্দ।
প্রেমের কবির আজ ১৭ ফেব্রুয়ারি ১২১ তম জন্মজয়ন্তী। শ্রদ্ধা; ভক্তিতে তাঁকে স্মরণ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আবার আসিব ফিরে, ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়…
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মবার্ষিকীতে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণামTribute to Jibanananda Das, one of the greatest Bengali modern poets, on his birth anniversary
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) February 17, 2020
শুদ্ধতম রূপসী বাংলার কবি ১৮৯৯ সালের ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহন করেন।
জীবনান্দকে ছাড়া প্রকৃতি অধরা, গ্রামের নারী অধরা, নারীর চালধোয়া হাত অধরা। সে যে কতটা গভীর, কতটা শ্বাশত তা অনুভব করে বাঙালি একমাত্র জীবনানন্দের কবিতায়।
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী এই লেখক একাধারে কবি, অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, উপন্যাসিক, গীতিকার।
তার কবিতা বাংলার রূপ, প্রকৃতি, মানুষের জীবনধারা, মাটি, তাদের কর্ম, দুঃখ-কষ্ট, বৃটিশ শাসনবিরোধী, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উঠে এসেছে। কবিতা নির্মিতিতে ভিন্ন আঙ্গিকে, ভাষাগতভাবে পূরাণকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন জীবনানন্দ। রবীন্দ্রোত্তর কবিতায় তার মতো ভিন্নভাবে সৃষ্টিশীলতা আর কারও মধ্যে কাজ করেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কবি ততটা জনপ্রিয়তা না পেলেও মৃত্যুর পর তার সৃষ্টিশীলতাই তাকে শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে।
এক জীবনের ভঙ্গুর প্রেম, দেখা-না-দেখা অসফল মোহগ্রস্থ সম্পর্ক জড়ো করলে জীবনানন্দের প্রেমের ভুবনটা ছিল মূলত শুষ্ক। ব্যক্তিগত জীবনে যেসব প্রেম আরাধ্য ছিল সেগুলো অধরাই থেকে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাতে বা প্রেমের ফলাফলে লাভালাভ গুনতে গিয়ে দেখেন সকলই শূন্য! স্ত্রীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিল তিক্ত।
অসফল হলেও তাঁর প্রেমের সম্পর্কগুলি নিয়ে লিখতে গেলে যে অবয়বের দেখা মেলে সেখানে ধূসরতা, রয়েছে একটি মস্তবড় গ্রে এরিয়া। অনেকটা আবছায়া আর অনুমান নির্ভর তথ্য হাতড়েই অগ্রসর হতে হয়।
জীবনানন্দের কবিতায় এরকম আকস্মিক আক্রমণ অনুসরণীয়। কোথাকার বক্তব্য যেন কোথায় বসিয়ে দেন ! মনে হয় যেন, এসবের পরম্পরা কী? মনে হবে কী হল! এরকম কথা কেন এখানে? রহস্যময় কবি, তাঁকে বুঝতে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।
”বলতে দ্বিধা নেই, জীবনানন্দ দাশকে দেখে আমি হতাশ হয়েছিলাম। দেখতে মোটেই কবির মতো নন তিনি। কালো, স্থ’লকায়; চেহারা বৈশিষ্ট্যবর্জিত। শুধু চোখে ছিলো একধরনের মায়া। আর হাসি ছিলো জোরালো এবং খাপছাড়া। যিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কিংবা বিষ্ণু দে’র মতো কান্তিমান নন, তিনি কী করে অমন রহস্যসমৃদ্ধ, আশ্চর্য রূপসী কবিতা লিখেছেন— এমন একটি প্রশ্ন আমাকে ক্ষণিকের জন্য বিচলিত করেছিলো।”(অসীমের সৈকতে/শামসুর রাহমান/ জীবনানন্দ: জীবন আর সৃষ্টি: সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত/পৃষ্ঠা: ১১৮।
মাল্যবান উপন্যাসের ছত্রে-ছত্রে জীবনানন্দের আভিজাত্যপূর্ণ ভাষার স্পর্শ পাওয়া যায়। স্ত্রী’র অবহেলায় নীচতলার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে একা একা রাত্রিবাসের পরেও যখন স্ত্রীর বড় ভাই এর আগমণে মাল্যবানকে নিজ গৃহ থেকে এক প্রকার বহিষ্কৃত হয়ে মেসে গিয়ে দীর্ঘ সাত মাস সময় কাটিয়ে আসতে হয়; সেসব দেখলে সাংসারিক জীবন নামক বিষয়টাকে পাঠকেরও দুর্বিষহ মনে হবে। অন্যদিকে স্ত্রীর বন্ধুর আগমণে স্বামী মাল্যবান যখন নীচতলার একা ঘরে প্রায় নির্বাসিত হয়ে যান তখন যেন কবি জীবনানন্দ চুপ করে এসে হাজির হন। তখনকার লেখার ভাষা একদম বদলে যাওয়া। ওখানে সাংসারিক টানাপোড়েন নেই, নুনের অভাব, ভাতের অভাব নেই। ওখানে স্মৃতির মধ্যে, ভাবনার মধ্যে পৌষের শীতের রাত, গ্রামের ছোট নদী, কাক- কোকিল আসা-যাওয়া করে, তখন রূপসী বাংলার কবির জন্মদিনের রাতে একা অসহায় না ঘুমোনো শরীরটাকে বড় বেশি পরিচিত মনে হয়। কেউ তার জন্মদিন মনে রাখে নি। তার শরীরের বয়স বাড়ে কেবল…।