দেশের নারীর জন্যে এর চেয়ে ভালো সংবাদ আর হতে পারে না। দেশের প্রতিটি মেয়ে চাইছে এভাবেই যেন সুপ্রভাত হয় ধর্ষকদের হত্যা করে।
শুক্রবার পুলিশের এনকাউন্টারে নিহত হয়েছে হায়দরাবাদে গণধর্ষণ ও নৃশংস খুনে ধৃত চার ধর্ষক।
পুলিশ কমিশনার ভিসি সাজ্জানার জানাচ্ছেন, ৬ ডিসেম্বর ভোর ৩.৩০ টার সময় তদন্ত চলাকালীন পুলিশি হেফাজত থেকে পালানোর চেষ্টা করে চার অভিযুক্ত। তখনই গুলি করে মারা হয় তাদের।
এ দিন তদন্তের জন্য ঘটনার পুনর্নির্মাণ করার কাজ করছিল পুলিশ। সেখানেই পুলিশের হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশের উপর চড়াও হয় তারা, এবং পলায়ন করতে চায়। সেই সময়েই পালটা গুলি চালিয়ে চারজনকে খতম করে পুলিশ।
এনএইচ ৪৪ নং জাতীয় সড়কের উপর এনকাউন্টার করা হয় চার ধর্ষককে।
গত সপ্তাহের বুধবার রাত ৯টা ২০ মিনিটে, হায়দরাবাদে এনএইচ ৪৪-এর ওপর পেশায় পশুচিকিৎসক ২৬ বছরের তরুণী প্রিয়াংকা রেড্ডির স্কুটির চাকা পূর্ব পরিকল্পনামাফিক পাংচার করে দিয়েছিল অভিযুক্তরা।
তার পরে এক ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারে গণধর্ষকরা।
এই ঘটনার দুদিন পর অর্থাৎ শুক্রবার চার অভিযুক্ত মহম্মদ আরিফ, জল্লু শিবা, জল্লু নবীন ও চিন্তাকুন্তা চেন্নাকেশাভুলুকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
চার ধর্ষককে শনিবার ১৪ দিনের বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠিয়েছিলেন তেলঙ্গানার শাদনগরের ম্যাজিস্ট্রেট। তেলঙ্গানার চেরাপল্লীর সেন্ট্রাল জেলে ছিল তারা। ফার্স্ট ট্র্যাক কোর্টে তাদের বিচার হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
নিহত তরুণীর বাবা জানিয়েছেন, ঘটনায় শান্তি পেয়েছেন তিনি। বলেন, “দশ দিন হয়ে গেল আমার মেয়েটা চলে গেছে। তার পরে শাস্তি হল ওর অপরাধীদের। সরকার ও পুলিশের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। এবার নিশ্চয় শান্তি পাবে আমার মেয়েটা।”
সব ঠিক আছে, কিন্তু আসলেই কি এনকাউন্টার অথবা ফাঁসি, শাস্তি দিয়ে নারী নির্যাতন বন্ধ করা যাবে? নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বিশ্বাস না করা, নারী নির্যাতন করা, এসবের গোঁড়াটা কোথায়? বারবারই তসলিমা নাসরিন সে কথা বলে আসছেন। আজ ফের টুইটারে পোস্ট করেন তিনি।
এ বিষয়ে বলছেন বাংলাদেশের লেখক তসলিমা নাসরিন।
In Bangladesh terrorists and drug dealers get killed in police encounter. In India 4 rapists and murderers were killed in a police encounter today. Time, money and energy are saved! In a way it is good, but is it good?
— taslima nasreen (@taslimanasreen) December 6, 2019
“বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী এবং মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশি এনকাউন্টারে নিহত হয়েছে। ভারতে আজ পুলিশি এনকাউন্টারে ৪ জন ধর্ষক এবং খুনি নিহত হয়েছে। সময়, অর্থ ও শক্তি সবই বেঁচে গেল! এক দিক থেকে এটি ভাল, তবে আদৌ এটি কি ভাল?” লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, পুরুষতন্ত্র যতদিন না বিলুপ্ত হচ্ছে সমাজ থেকে, ততদিন শাস্তিতে কিছু হবে না।
“ধর্ষকেরা ফাঁসিকে ভয় পায় কে বলেছে? অপরাধীরা অপরাধ করার সময় এ কথাটা গভীরভাবে বিশ্বাস করে যে তারা ধরা পড়বে না। হায়দারাবাদের ধর্ষকরাও তা মনে করেছে। তাই পুড়িয়ে এমনভাবে ছাই করে ফেলেছে প্রিয়াংকাকে, যেন কেউ তাকে চিনতে না পারে। তাকে চিনতে না পারলেই, তাদের বিশ্বাস, তারা দিব্যি বেঁচে যাবে। প্রশ্ন হলো, কেন তারা মনে করে তারা ধরা পড়বে না! মনে করে, কারণ এমন ঘটনা অহরহই ঘটে যে অপরাধীরা ধরা পড়ে না। জনতার ভিড়ে অপরাধীরা মিশে যায়। প্রমাণ ছাই করে দিয়ে অর্থাৎ নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে হায়দারাবাদের ধর্ষকরাও দিব্যি বেঁচে থাকতে চেয়েছিল।
দিল্লির বাসে গণধর্ষণের ঘটনা শুধু ভারতবর্ষেরই নয়, পৃথিবীর বহু দেশের মানুষকে কাঁপিয়েছে। ধর্ষকদের ফাঁসি হলো, কিন্তু ধর্ষণের সংখ্যা সমাজে সংসারে মোটেও কমেনি। মানুষ আর কত রাস্তায় নামবে প্ল্যাকার্ড পোস্টার হাতে, কতদিন আর চিৎকার করবে, চিৎকার করবে এবং যথারীতি কেউ শুনবে না। যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাগরিক, যারা ভারত ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক, তাদের বিশেষ করে মেয়েদের সাবধান করে দিয়েছে যে ভারতে ধর্ষণ, খুন প্রচন্ড বেড়েছে, পর্যটক মেয়েদেরও ছাড় দিচ্ছে না, সুতরাং ভারত ভ্রমণ থেকে বিরত থাকাই ভালো।
কয়েকজনকে আমি গত দুদিন বলতে শুনেছি, ‘কী পোশাক পরেছিল প্রিয়াংকা সেদিন?’ মনে হলো প্রিয়াংকার পোশাক দেখেই তারা বুঝে নেবে প্রিয়াংকা নিজে ধর্ষণকে ডেকে এনেছে কিনা। অর্থাৎ প্রিয়াংকাই দায়ী কিনা তার ধর্ষণ আর মৃত্যুর জন্য। গবেষকরা এত যে বলছেন, পোশাক কোনও কারণ নয় ধর্ষণের। তারপরও কারও বোধোদয় হয় না। এত যে বলা হচ্ছে ধর্ষণ কোনও যৌনসংগম নয়, এটি বর্বরতা, এটি বীভৎস নারী নির্যাতন… তারপরও মানুষ এটিকে যৌনসংগমই ভেবে নেয়। কয়েকজনকে এও বলতে শুনেছি পুরুষেরা যেন গণিকালয়ে গিয়ে যৌনক্ষুধা মেটায়, যেন ‘ভদ্র মেয়েদের’ রেহাই দেয়। আসলে গণিকালয়ে যারা যায়, তারা গণিকালয়ের মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করতে শিখে যায়, জেনে যায় এটি আইনত বৈধ। তারা কিন্তু সমাজের সব মেয়েকেই চেতনে-অবচেতনে যৌনবস্তু বা যৌনদাসী বলেই ভাবতে শুরু করে।
তনুর কথা মনে আছে? তনু নামের একটি উনিশ বছরের মেয়েকে কুমিল্লায় গণধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল। তনুর হিজাব তনুকে ধর্ষণ থেকে বা খুন হওয়া থেকে বাঁচাতে পারেনি। পুরুষ যখন মেয়েদের নির্যাতন করে, তারা মেয়েদের পোশাক দেখে করে না। তারা মনে করে নির্যাতন করার অধিকার তাদের আছে, সে কারণেই করে নির্যাতন। যদি শৈশব থেকে মানুষকে শিক্ষিত করা হয় মেয়েরা মানুষ, মেয়েরা যৌনবস্তু নয়, তাহলে দেখা যায় সেই সমাজে মেয়েদের উলঙ্গ অবস্থায় দেখলেও পুরুষ মনে করে না, তাদের কোনও রকম অশালীন মন্তব্য করার বা তাদের স্পর্শ করার অধিকার কোনও পুরুষের আছে। অসভ্য সমাজে পুরুষেরা, নারী যে পোশাকই পরুক না কেন, নারীকে যৌন হেনস্তা করে। সভ্য সমাজে পুরুষরা, নারী যে পোশাকই পরুক না কেন, নারীকে যৌন হেনস্তা করে না।
শোনা যায়, নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা তনুকে ধর্ষণ করেছিল। রক্ষকরা কী যে অনায়াসে ভক্ষক বনে যেতে পারে! মেয়েদের জন্য সম্ভবত ‘নিরাপত্তা’ এখন আর অধিকার নয়, নেহাতই লাক্সারি। আজকাল যারা ধর্ষণ করে তারা ধর্ষণ করাটা অন্যায় জেনেই ধর্ষণ করে। মানুষ যত সভ্য হয়েছে, ধর্ষণের সংজ্ঞা তত পাল্টেছে। এক সময় ধর্ষণকে কোনও অপরাধই বলে মনে করা হতো না। বাংলাদেশের মতোই অবস্থা ভারতে।
ধর্ষণ বন্ধ করার পথে এগোতে হলে কী কী করতে হবে! রাস্তাঘাটে অফিসে-আদালতে দোকানপাটে মেয়েদের যৌন হয়রানি বন্ধ করতে হবে, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা, জাতপাত বন্ধ করতে হবে, মেয়েদের শিক্ষিত করতে হবে, স্বনির্ভর করতে হবে। ইস্কুলের শুরু থেকেই নারী-পুরুষের সমানাধিকারের শিক্ষা সব শিশুকে দিতে হবে। শিশুরা ভালো শিক্ষা আর ভালো পরিবেশ পেলে মানুষ ভালো হয়।”
ধর্ষণের একমাত্র কারণ পুরুষতন্ত্র। এই বিষকে সমাজ থেকে উপড়ে ফেলার জন্যে বাড়ি থেকে, বিদ্যালয় থেকে পুত্র সন্তানকে শিক্ষা দিতে হবে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের।