আজ ৩ জানুয়ারি। রবীন্দ্রসংগীতকে যে চার কিংবদন্তী শিল্পী সারা বিশ্বে এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ভারতীয় বাঙালি গায়িকা সুচিত্রা সেনের অষ্টম প্রয়াণ দিবস।
বিশিষ্ট অন্য ৩ জন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হলেন দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কলকাতা দূরদর্শনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সুচিত্রা মিত্র একবার বলেছিলেন, “দ্যাখো রবীন্দ্রনাথের গান ভেতরে নিতে গেলে ওঁর অনেক রচনা অভ্যাস করতে হবে। এককথায় মানুষটাকে আরো ধ্যান দিয়ে দেখতে হবে।”
নিজের গানের গায়নে একধরনের রূপের সম্পূর্ণতার আকাংক্ষা করতেন বিশ্বকবি। সেই আকংক্ষার চরিতার্থতা পেয়েছিলেন তাঁর সমসাময়িক প্রসিদ্ধ গায়িকা সাহানা দেবীর মধ্যে। এই ঘটনার ৫০ বছর পর কবির আকাংক্ষার সেই মূর্তিমতী প্রতিমা সাহানা দেবী যার গানে নিজেকে উজাড় করে দেয়া ধ্যানসম্পূর্ণতার নজির আবিষ্কার করেছিলেন তিনিই সুচিত্রা মিত্র।
সাবলীল মননশীলতায় এবং গভীরবোধে বাঙালি শ্রোতার কানে বাঁধা রয়েছে সুচিত্রার উদাত্ত কন্ঠ।
১৯৪৫ সালে প্রথম রেকর্ডে মুক্তি পেয়েছিল তাঁর গান। একপিঠে ‘মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান’, অন্যপিঠে ‘হৃদয়ের এ কূল ও কূল’।
রবীন্দ্রনাথের গানের পরিবেশন যে একটা শৃংখলাকে দাবি করে, এই সত্যকে নিজের গায়নের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।
১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার দৃপ্ত কণ্ঠে গাওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। ২০০১ সালে তিনি কলকাতার শেরিফ মনোনীত হয়েছিলেন।
সুচিত্রা মিত্র মনে করতেন, একজন শিল্পীর শুধু গান গাইলেই সমস্ত দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। যুক্তিসহ এই বদমেজাজি সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করাও শিল্পীর কর্তব্য।
কলেজ জীবনে তিনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অভিযোগে যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের মুক্তির জন্যে পতাকা হাতে মিটিং মিছিলে যোগদান করেন তিনি। ব্রিটিশ পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন বহুবার।
১৯৬০ সালে নয়া দিল্লি থেকে প্রচারিত আকাশবাণীর জাতীয় অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন তিনি। আকাশবাণীতে জওহরলাল নেহরুকে কটাক্ষ করে বাল্মীকি প্রতিভা’ইয় গান গাওয়ার অভিযোগে তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘ ৬বছর বঞ্চিত ছিলেন তিনি। পরবর্তী জীবনে রাজনীতি ছেড়ে দিলেও তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠস্বর আমৃত্যু অম্লান ও অক্ষুণ্ণ ছিল।
সুচিত্রা মিত্রের আবক্ষ মূর্তি নির্মাণ করেছেন রামকিংকর বেইজ। তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন সুব্রত ঘোষ ও রাজা সেন।
বিশিষ্ট ‘উলঙ্গ রাজা’র কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সুচিত্রাকে নিয়ে রচনা করেছেনঃ
আকাশ যখন চক্ষু বোজে অন্ধকারের শোকে/ তখন যেমন সবাই খোঁজে সুচিত্রা মিত্রকে/ তেমন আবার কাটলে আঁধার সূর্য উঠলে ফের /আমরা সবাই খোঁজ করি কার? সুচিত্রা মিত্রের।
দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ২০১১ সালের আজকের দিনে কলকাতার বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সুচিত্রা মিত্র।
নর্থ ইস্ট নাও’ পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর চরণে রইল গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।