“নারীদেহ প্রদর্শনকারী উত্তেজক পোশাকের উৎপাদন এবং বিপণন বন্ধ করতে হবে।” নীচে লেখা রয়েছে নীল রঙে ‘বাঙালি মহিলা সমাজ!’
আশ্চর্য মনে হলেও এটাই সত্যি। নিজের চোখকে অবিশ্বাস করা যায় না।
কয়েক দিন আগে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের কাছে একটি অস্থায়ী প্রসাধন সামগ্রীর দোকানের সামনে লাগানো হয়েছে এই ঘৃণ্য ব্যানার। সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, মুক্তচিন্তার পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত কলকাতার বুকে এহেন তালিবানি ফতোয়া ব্যানার দেখে ক্ষুব্ধ জনগণ।
হায়দরাবাদে পশু চিকিৎসক প্রিয়াংকা রেড্ডির গণধর্ষণ এবং নৃশংসভাবে তাঁকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় উত্তাল হয়ে সারা দেশ। কিন্তু কয়জন সমাজ থেকে ধর্ষণের মূল কারণ যে পুরুষতন্ত্র, সে তন্ত্রকে সমূলে উৎপাটন করার কথা ভাবছেন?
পুরুষতন্ত্রের সেবক এবং বাহক কী শুধুই পুরুষ? মোটেও তা নয়। পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক দুটোর মধ্যেই কিন্তু নারীরাও রয়েছেন। যারা বুঝেও না বোঝার ভান করে পুরুষতন্ত্রকে লালন-পালন করে বিকাশে সাহায্য করছে।
এই ব্যানারে ফের তা প্রমাণ হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গবাসী ধিক্কার দিচ্ছে এই লেখাকে।
কারণ এমন নারী বিদ্বেষী লেখা কোন সভ্য সমাজের পরিচায়ক নয়। কোন সভ্য সমাজে নারী নির্যাতন হয় না। পুরুষকে যদি ঘর থেকেই শিক্ষা দেয়া হয়, নারী যৌনবস্তু নয়, সে মানুষ। তবে নারী উলংগ থাকলেও একজন পুরুষও ধর্ষণ তো দূর, বিকৃতি দৃষ্টিতেও তাকাবে না।
নারীর কোন পোশাক তা সে হাঁটু সমানই হোক অথবা বুক কাটা। তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ ধর্ষক, বিকৃতকাম পুরুষদের কাছে পোশাক কোন মুখ্য বিষয় নয়। তাঁদের কাছে মুখ্য, নারী যৌনবস্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। পোশাক যদি সত্যিই বিষয় হত, তাহলে বাচ্চা বাচ্চা শিশুদের ধর্ষণ হতে হতো না। আদৌ কি আজকাল ধর্ষকদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে গরু-ছাগলও। পাচ্ছে না। পাবে না। যতদিন না সমাজ থেকে পুরুষতন্ত্রকে গোঁড়া থেকে ছিন্ন করা যাচ্ছে।
সম্প্রতি ওই পোস্টারের বিরুদ্ধে শ্যামবাজার চত্বরে জমায়েতের ডাক দেন কয়েকজন তরুণ–তরুণী। তাঁদের প্রশ্ন, ‘উত্তেজক’ পোশাকের জন্যই কী পুরুষের যৌনলালসা জাগে? তাহলে দু’বছরের শিশুকন্যা বা আশি বছরের বৃদ্ধা ধর্ষিতা হন কেন? আর যৌনলালসা জাগলেই কি নারীকে ধর্ষণ করার অধিকার পাওয়া যায়? এলাকাটি শ্যামপুকুর থানার অন্তর্গত হওয়ায় সেখানে গিয়ে তাঁরা জমায়েতের অনুমতিও নেন।
সমাজে কিটদষ্ট পুরুষরাই শুধু ধর্ষক নয়, তাদের যারা এই সমস্ত নারী-পুরুষের সমানাধিকার না মানা, নারী বিরোধী, নারী ধর্ষণে প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে, তারাও সমানে ধর্ষক। তারাও কিটদষ্ট। সমাজের নোংরা একটি বাড়তি অংশ ছাড়া আর কিচ্ছু নয়।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাগরিক, যারা ভারত ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক, তাদের বিশেষ করে মেয়েদের সাবধান করে দিয়েছে যে ভারতে ধর্ষণ, খুন প্রচন্ড বেড়েছে, পর্যটক মেয়েদেরও ছাড় দিচ্ছে না, সুতরাং ভারত ভ্রমণ থেকে বিরত থাকাই ভালো।
ধর্ষক নিয়ে বাংলাদেশের লেখক তসলিমা নাসরিন লিখছেনঃ
“কয়েকজনকে আমি গত দুদিন বলতে শুনেছি, ‘কী পোশাক পরেছিল প্রিয়াংকা সেদিন?’ মনে হলো প্রিয়াংকার পোশাক দেখেই তারা বুঝে নেবে প্রিয়াংকা নিজে ধর্ষণকে ডেকে এনেছে কিনা। অর্থাৎ প্রিয়াংকাই দায়ী কিনা তার ধর্ষণ আর মৃত্যুর জন্য। গবেষকরা এত যে বলছেন, পোশাক কোনও কারণ নয় ধর্ষণের। তারপরও কারও বোধোদয় হয় না। এত যে বলা হচ্ছে ধর্ষণ কোনও যৌনসংগম নয়, এটি বর্বরতা, এটি বীভৎস নারী নির্যাতন… তারপরও মানুষ এটিকে যৌনসংগমই ভেবে নেয়। কয়েকজনকে এও বলতে শুনেছি পুরুষেরা যেন গণিকালয়ে গিয়ে যৌনক্ষুধা মেটায়, যেন ‘ভদ্র মেয়েদের’ রেহাই দেয়। আসলে গণিকালয়ে যারা যায়, তারা গণিকালয়ের মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করতে শিখে যায়, জেনে যায় এটি আইনত বৈধ। তারা কিন্তু সমাজের সব মেয়েকেই চেতনে-অবচেতনে যৌনবস্তু বা যৌনদাসী বলেই ভাবতে শুরু করে।”
ধর্ষণ বিষয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন পরিচালক ড্যানিয়েল শারভান। তিনিও যে কতটা ধর্ষক এবং পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক প্রমাণ করে দিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লম্বা লিখেছেনঃ
‘মহিলাদের উচিত ব্যাগে কন্ডোম রাখা এবং ধর্ষকদের সঙ্গে সহযোগিতা করা। তাহলে আর কোনও মহিলাকে খুন হতে হবে না।’ তাঁর কথায়, অযথা চিত্কার না করে মহিলাদের উচিত পুরুষদের যৌন বাসনা পূরণ করা। তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
ধিক্কার জানাই এই পুরুষতন্ত্রকে!