রানাঘাটের রানু মণ্ডলের জোয়ারে ভেসে চলেছে আজ সারা দেশ। এপার-ওপার বাংলার মানুষ মন দিয়ে শুনছে হিমেশ রেশমিয়ার সঙ্গে রানুর ‘তেরি মেরি’ প্ল্যা-বেক।
রানু মণ্ডল পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাট স্টেশনে গান গেয়ে যে দু-চার পয়সা পেতেন, তা দিয়েই কোনমতে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি নিবারণ করতেন।
তবে এটা সত্যি, দারিদ্র্যতাও তাঁর গানের গলাকে দমাতে পারেনি। এমনই সহজাত কিছু প্রতিভা নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে কখনো-সখনো।
সকলের ভালবাসায়, বিশেষণে রানুদি আজ ‘লতাকণ্ঠি’ নামে পরিচিতি পেলেন। চুল কালি করানো হলো, মুখে স্নো পাউডার মাখানো হলো, খসখসে চামড়ায় তেল সাবান মেখে রঙিন করা হল।
পেশায় ইলেকট্রিক্স টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার অতীন্দ্র রানুদির কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে তাঁর গান রেকর্ড করে ফেসবুকে ভাইরাল করেন সেই ভিডিও। চোখের পলকে তা ছড়িয়ে পড়ে।
রানু মণ্ডল সমাজের দরদীদের চেষ্টায় আজ সব পেয়েছেন। গাড়ি-বাড়ি-টাকা-পয়সা কোন কিছুর অভাব নেই বর্তমানে। জানা গেছে, হিমেশ রেশমিয়া ‘তেরি মেরি’ গানটি গাওয়ার জন্যে ৬-৭ লক্ষ টাকা দিয়েছেন।
রানুদির এত প্রশংসার মাঝখানে হঠাৎ তাঁর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়ে। এবং সেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি রাগত স্বরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।
তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, অতীন্দ্রের মতো সহানুভূতিশীল মানুষের দৌলতে তিনি এত জায়গায় যাচ্ছেন, এনিয়ে তিনি কী বলবেন? এর উত্তরে রাণু যা বলেছেন, তাতে রেগে লাল নেটিজেনরা। তিনি বলেছেন, “ভগবানের দৌলতে যাচ্ছি। ওরা ভগবানের সারভেন্ট, চাকর। আমি ওদের সাহায্যে যাচ্ছি না। ভগবানের সাহায্যে যাচ্ছি। ওরা ভগবানের চাকর হয়ে যাচ্ছে।”
সোশ্যাল মিডিয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রানুর এমন কথায়। কোন কোন লোক এমনও মন্তব্য করেছেন, রাস্তার কুকুরকে বেশি নাই দিয়ে মাথায় তুললে যা হয়!
তবে যদি বলা হয়, রানু মণ্ডলের জীবন সোজাসাপ্টাভাবে চলে যাচ্ছিল। সেখান থেকে তিনি আজ যে স্থানে পৌঁছেছেন, তা তাঁর কোনদিনই ভাবনায় ছিল না। তিনি চাননি এত কিছু। তাঁকে দেয়া হয়েছে। রানুদি আজ লাখপতি অতিন্দ্রবাবুর জন্যেই।
তাছাড়া, সকলের কথানুযায়ী, যে অতীন্দ্রকে তিনি ‘চাকর’ বলেছেন বলে ক্ষেপে উঠেছে সমাজ, সে অতীন্দ্রবাবুর কিন্তু কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, যিনি প্রকৃত উপকার করেন, তিনি প্রতিদানের আশা না করেই করেন। সূর্যের তো গা জ্বলছে না, জ্বলছে আশেপাশে অবস্থান করা নক্ষত্রের!
উপকার করে সমালোচনার আগুনে কারা না বিদ্ধ হয়েছেন? রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সকলে। কিন্তু পরোপকার যাঁর ধর্ম তিনি বিদ্ধ হয়েও করে যাবেন।
হ্যাঁ, তবে এটাও ঠিক রানুদি এভাবে অকৃতজ্ঞের মতো কথা বলা মোটেও উচিৎ হয়নি। উল্লেখযোগ্য যে, রানুদি এতটাই সাফল্য কিংবা আনন্দের জোয়ারে ভেসে চলেছেন যে, তাঁর নিজেরও বোধ নেই, তিনি কি বলছেন। অসংলগ্ন কথা বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে।
বলা বাহুল্য, রানুদিকে আমরাই গাছের মগডালে বসিয়েছি, এবার গোড়াটা কেটে নিলেও রানুদির অন্তত কিছু করার থাকবে না। কিন্তু, একজন অজ্ঞানী মানুষ যদি কোন কিছু বলেই থাকেন, এত তেঁতে ওঠার কিছু নেই। কারণ পৃথিবীতে অশিক্ষিতের থেকে শিক্ষিতরাই কিন্তু অধিক অকৃতজ্ঞ এবং একসময় প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়ে ফের ধুলোয় লুটিয়ে দিতে পছন্দ করে থাকেন! একটু চারপাশে দৃষ্টি দিলে অহরহ এমন ঘটনা চোখে পড়ে।
সমাজের নিয়মই তো উচ্চস্থানে উঠিয়ে কিছুক্ষণ মাথায় তুলে নাচানাচি করে এক ঝটকায় ফের মাটিতে মিশিয়ে দেয়া।
এবার একটু স্রোতের বিপরীতেও চলার চেষ্টা করে দেখুন!
দেশি প্রবাদে বললে, ‘সামনে দিয়ে হাতি গেলে দেখে না, পেছন দিয়ে পিঁপড়ে হেঁটে গেলে নজরে পড়ে।’
সমাজে শিক্ষিতরাই তো কখনো দেখা যায়, কতরকম নীচ মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন! তাঁরা কিন্তু সেখান থেকে অনায়াসে বেরিয়ে যেতে পারেন। কারণ তাঁদের প্রতিপত্তি রয়েছে।
রানুদি কিছু চাননি, তাঁকে ভালবেসে দেয়া হয়েছে। সুতরাং আজ যা তিনি বললেন, পাল্টা আমরাও যদি এভাবে তাঁকে আক্রমণ করি, তাহলে সভ্যতা, ব্যবহারে দু-পক্ষের মধ্যে কোন তফাত থাকছে কী?
সর্বশেষ বলা যায়, রানুদির এই সাফল্য যেহেতু অনাকাংক্ষিত, সুতরাং তাঁর ব্যবহারে এসে পড়েছে ব্যতিক্রম। রানুদি নিজেও হয়তো জানেন না, কতদিন এ সাফল্য ধরে রাখতে পারবেন!