হাজার চুরাশির মা’র স্রষ্টা মহাশ্বেতা দেবী! তেজস্বী, পুরুষতান্ত্রিকতার গালে সপাটে চড় মারা লেখক মহাশ্বেতার আজ শুভজন্মদিন।
দেশভাগের কারণে, দেশভাগের যন্ত্রণাকে বুকে লালন করে বাংলাদেশ থেকে যে সকল ক্ষণজন্মা ভারতে চলে এসেছিলেন, বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকারকর্মী মহাশ্বেতা দেবী তাঁদেরই একজন।
স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর ৯৪ তম জন্মবার্ষিকী আজ।
মহাশ্বেতা দেবীর বিদ্যালয় শিক্ষা শুরু হয়েছিল ঢাকা শহরেই। ভারত বিভাজনের পর চলে আসেন এপার বাংলা পশ্চিমবঙ্গে। শান্তি নিকেতনে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ ভবন থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন বিশিষ্ট এই লেখক।
মহাশ্বেতা দেবী নকশালবাড়ির আন্দোলনের নিহত হাজার হাজার সম্ভবনাময় তরুণদের কথা, তাদের মায়েদের ব্যথাকে যথাক্রমে ব্রতী এবং মা সুজাতার ভেতর দিয়ে ধারণ করতে চেয়েছেন। সেই সঙ্গে স্বচ্ছ দর্পনে দেখিয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষরা কিভাবে স্ত্রী-সন্তান বর্তমানেও চরিত্রহীন;বহুগামী হয়ে থাকেন! লেখকের এক একটি অক্ষর; শব্দ হৃদয়ে ঢেউ তোলে।
ফের দেখিয়েছেন, নকশালবাড়ী আন্দোলনের পেছনে তো ধর্মীয় উন্মাদনা ছিল না, ছিল আর্দশগত উন্মাদনা। ঠিক একইভাবে সুজাতার যন্ত্রণাটা এই উপন্যাসের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে যেতেও পারত, কিন্তু পারেনি, কারণ সুজাতা পুত্রের মৃত্যুতে অন্তত লজ্জিত নন। কিন্তু জঙ্গিবাদী উৎসাহে গলাকেটে মানুষ হত্যা করা নির্মম কাণ্ডে তার পিতামাতারা সন্তানের লাশ গ্রহণ পর্যন্ত করতে রাজি হননি, কারণ এই মৃত্যু গ্লানির, এই মৃত্যু চরম লজ্জার। পিতা হিসাবে লজ্জার, ততটাই লজ্জার সেই মায়েদের– যারা এমন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
নকশালবাড়ী আন্দোলনের সূত্রে সত্তর দশককে বলা হয় ‘মুক্তির দশক’।
‘সেই ব্রতী। মুক্তির দশকে এক হাজার তিরাশিজনের মৃত্যুর পরে চুরাশি নম্বরে ওর নাম।’ মর্গে সংখ্যার হিসেবে তার লাশ দেখতে গিয়েছিলেন তার মা সুজাতা।
‘সকাল’, ‘দুপুর’, ‘বিকেল’ ও ‘সন্ধ্যা’– এই চারটি ভাগে সৃষ্ট এই উপন্যাস আমাদের যেন বলতে চায় যে: উগ্রপন্থার উন্মেষ, বিকাশ, বৃদ্ধি ও প্রকাশ আছে; কিন্তু এটা কখনোই রাত্রি পার হয়ে নতুন কোনো ভোরের দিকে যায় না, যেতে পারে না। ‘সন্ধ্যা’ই এর সমাপ্তি কাল। তবে আমাদের শুরু করতে হবে নতুন কোনো অন্ধবিন্দু থেকে, যেটি এখনও অচিহ্নিত ও অনির্দিষ্ট।
পশ্চিমবঙ্গের লোধা ও শবর উপজাতি, নারী ও দলিতদের লড়াই, অসহায়তার কথাই তার লেখায় উঠে এসেছে৷ বহুবার ভারতের উপজাতি মানুষদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন ভারতীয় এই কথাসাহিত্যিক৷তাদের অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেছেন৷
মহান লেখক মহাশ্বেতা দেবীর বিশেষত্ব এই যে, বাংলা উপন্যাসে দলিত শ্রেণির মানুষজনের সর্বাধিক উপস্থিতি ঘটিয়েছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সৃষ্টি জার্মান, জাপানি, ফরাসি এবং ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। এছাড়াও হিন্দি, অসমিয়া, তেলেগু, গুজরাটি, মারাঠি, মালয়ালম, পাঞ্জাবি, ওড়িয়া এবং আদিবাসী হো ভাষায়ও অনুবাদ হয়েছে।
আপামর জনগণের চোখের মণি মহাশ্বেতা দেবী সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (বাংলায়), জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ও র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার সহ একাধিক সাহিত্য পুরস্কার এবং ভারতের চতুর্থ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান যথাক্রমে পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ লাভ করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণে ভূষিত করেছিল।