ঘুমিয়ে আছে অপু- দুর্গা , সব শিশুরই অন্তরে !
“দিদি খাসনি !” কিন্তু দিদি কি আর শোনে !!??
সে বনে বনে আঁচল উড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় ।
দুষ্টু ভাই তার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে,,,দিদি পুকুর থেকে পানফল তোলে।
নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম সদা জাগ্রত, দু ভাই -বোনের ছুটাছুটিতে।
কিন্তু আত্মা থমকে দাঁড়ায় এক জায়গায় । সমগ্র কাহিনির চরম মর্মান্তিক দৃশ্য!!
চিনিবাস ময়রা থাকে ও পাড়ায়। সে জানে হরিহরের দুয়ার দিয়ে মিষ্টি নিয়ে গেলেও নেবার কেউ নেই। তাই আর সে ওখানে দাঁড়ায় না। মুখুজ্যেদের বাড়ির দিকেই রওনা দেয় ।
সরল অপু -দুর্গা চিনিবাসের পেছন পেছন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ছুটে চলে ।
ভাই – বোন সবুজ, তাইতো তারা অবুঝ~~
উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলে যেন তীক্ষ্ণ চাবুক।
কিন্তু এ ছুটা , এ দেখা বিশুদ্ধ দেখা, নির্লোভ দেখা !
তাদের সামর্থ্য নেই, কিন্তু লোভও নেই ।
মুখুজ্যে বাড়ি বলতেই পারে, বুভুক্ষু আত্মার নজর লেগে
তার সন্তানের শরীর খারাপ করবে ,, কিন্তু প্রকৃতি কখনোই বলে না । সে তাদের মুক্ত হৃদয়ে সর্বস্ব দান করছে।
অপু- দুর্গা র জিভ কিনে খাওয়া মিষ্টির স্বাদ পায়নি ঠিকই , কিন্তু পানফলের স্বাদ পেয়েছে !
অপু-দুর্গার নামেই বাঙালির স্মৃতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে ‘পথের পাঁচালি’র স্রষ্টা বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। তাই না? বাংলার সাহিত্যিকের আজ ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী।
তাঁর রচনায় প্রকৃতির সৌন্দর্য ও গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনের সতেজ চিত্র পাওয়া যায়। শরৎচন্দ্র পরবর্তী বাঙালি ঔপন্যাসিকদের মধ্যে বিভূতিভূষণ অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলা সাহিত্যে তাঁর রচনা মৌলিক হিসেবে পরিচিত।
সাধারণ হয়েও অসাধারণ শব্দের গাঁথুনিতে তাঁর সৃষ্টি হয়ে উঠেছে সেরা। তাঁর লেখার শৈলি পাঠককে জায়গা ছেড়ে উঠতে দেয় না। তাঁর সাহিত্যে প্রকৃতি উঠে এসেছে জ্যান্তব হয়ে!
বাস্তবের কঠোরতাকে অতিক্রম করে নয়, তাঁর সাহিত্য শেখায় কঠিন সময়ের মধ্যেও কোন কৌশলে কোমল থাকা যায়, মানবিক থাকা যায়। সরস মনেই সৃষ্টির বীজ বপন করা যায়। সেই বীজ বপন করতে, মনকে সদা উর্বর রাখতে সাহায্য করে তাঁর এক-একটি লেখা।
বিভূতিভূষণ তাঁর সাহিত্যে প্রকৃতি ও মানব জীবনকে অবিচ্ছিন্ন সত্তায় ধারণ করেছেন। তার রচনা শুধু প্রাকৃতিক বর্ণনা নয়, এতে রয়েছে গভীর জীবনবোধ। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী ও অপরাজিত বাংলা সাহিত্যের দুই অমূল্য সম্পদ। যদিও তার সব লেখাই উল্লেখ করার মতো।
তাঁর ছোট গল্পগুলোর মধ্যে গীতিকবির দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : পথের পাঁচালি (১৯২৯), অপরাজিত (১৯৩১), দৃষ্টি প্রদীপ (১৯৩৫), আরণ্যক (১৯৩৮), আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০), দেবযান (১৯৪৪), ইছামতী (১৯৪৯)।
ছোট গল্প সংগ্রহ : মেঘমল্লার (১৯৩১), মৌরীফুল (১৯৩২), যাত্রাবদল (১৯৩৪), কিন্নর দল (১৯৩৮)। আত্মজীবনীমূলক রচনা : তৃণাঙ্কুর (১৯৪৩) ইত্যাদি।
১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের চব্বিশ পরগনার মুরারিপুর গ্রামের মামার বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
বিভূতিভূষণ গ্রামজীবনের রূপকার। ‘পথের পাঁচালী’ থেকে শুরু করে ‘অশনি সঙ্কেত’ পর্যন্ত তার সাহিত্য পরিক্রমায় এ পরিচয় চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
তাঁর উপন্যাসের পুরো অবয়বটি পরিচ্ছন্ন, জটিলতা-কুটিলতার উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ে না।
এ থেকে বোঝা যায়, মানব জীবনের কদর্য দিকগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক বা পরিচয় গভীর ছিল না। গ্রামীণ মানুষ ও সমাজের সরল, অবিকল উপস্থাপন, প্রকৃতির কোলে লালিত ও পরিশীলিত মনন আর সুন্দর রুচির কারণে তার উপন্যাসগুলো হয়ে উঠেছে অনবদ্য।
এগুলোর আবেদন পাঠক হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়, যাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় এ লেখকের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানালাম।