“নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন,
তুই সুখি জনের করিস পূজা, দুঃখীর অযতন।”
লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যরিষ্টার, গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী অতুলপ্রসাদ সেনের মতো মহৎ মানুষেরাই বোধকরি এমন বাণী উচ্চারণ করতে পারেন।
বিশিষ্ট বাঙালি গীতিকার, সুরকার একধারে সঙ্গীতজ্ঞ অতুলপ্রসাদ সেনের আজ ৮৫ তম মৃত্যুদিন। প্রখ্যাত গীতিকারের চরণে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান…
Homage to composer, lyricist and singer Atul Prasad Sen on his death anniversary
অতুলপ্রসাদ সেনের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) August 26, 2019
অতুলপ্রসাদ সেনকে বলা যায় বাংলা সংগীত জগতের স্থপতি। তিনি বাংলা গানে ঠুংরি ধারার প্রবর্তক। শুধু তাই নয়, বাঙালি কোনদিন অতুলপ্রসাদের অতুলনীয় কীর্তিকে ভুলতে পারবে না। তিনিই প্রথম বাংলায় গজল রচনা করেছিলেন।
অতুলপ্রসাদী গান বললেই বাঙালির হৃদয় কেঁপে ওঠে। আবেগঘন হয়ে পড়ে মন। তাঁর গানের মূল উপজীব্য বিষয় ছিল দেশপ্রেম, ভক্তি এবং প্রেম। জীবনের যন্ত্রণাগুলো তিনি হাসিঠাট্টায় মজে থেকে উড়িয়ে দিতেন ঠিকই, কিন্তু ‘সাহিত্য তো মনের দর্পণ’। তাই সেখানে ধরা পড়ে যেত জীবনের বেদনাগুলো। ঢাকায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অতুলপ্রসাদ।
তিনি লিখেছিলেন,
“মনোদুখ চাপি মনে হেসে নে সবার সনে,
যখন ব্যথার ব্যথীর পাবি দেখা
জানাস প্রাণের বেদন।”
একরাশ কান্নাকে অতুলপ্রসাদের মতো মানুষেরাই খুশি চেহারা দিয়ে আড়াল করে রাখতে পারেন।
তাঁর গানের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অতুলপ্রসাদ সেনের ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা’ প্রেরণা যুগিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে।
অতুলপ্রসাদের জীবন তোলপাড় করে দিয়েছিল দুটো ঘটনা। এক হচ্ছে তাঁর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে। অন্যটি, তিনি তাঁর মামাতো বোন হেমকুসুমকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু সংসারে কোনদিন সুখের আলো দেখতে পাননি অতুলপ্রসাদ! দুটো ঘটনা তাঁকে কুরে কুরে খেয়েছে আজীবন।
তাঁর মা হেমন্তশশী দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জ্যাঠামশাই দুর্গামোহন দাশ। অতুলপ্রসাদ এ ঘটনা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। কারণ বাবা মারা যাবার পর মা-ই ছিল তাঁর জীবন। অভিমানে তিনি চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তিহলেন প্রসিডেন্সী কলেজে।
এরপর মামারা তাঁর ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে প্রলেপ দেবার জন্যে লন্ডনে মিডল টেম্পলে ভর্তি করালেন ব্যারিষ্টারের আশায়।
সেখানে প্রবাসি বাঙালিদের মত দীর্ঘদিন ঘরছাড়া অতুলপ্রসাদও অনুভব করেন সুজলা সুফলা বাংলা মায়ের টান। মা হেমন্তশীর জন্য মন কেঁদে উঠল।
এরপর সৌভাগ্যজনক তো বলা যায় না, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর প্রেম হয় মামাতো বোন হেমকুসুমের সঙ্গে। তাঁর রূপে, ব্যক্তিত্বে তিনি পাগল হয়ে ওঠেন। না বুঝে পতঙ্গ আগুনে ঝাঁপ দিল। একেবারে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলেন অতুলপ্রসাদ।
আত্মীয়স্বজন কেউ মেনে নিতে পারেনি ভাই-বোনের এ বিয়ে। কিন্তু অতুলপ্রসাদ জেদ ধরলেন। ফলে সকলে তাঁদের পরিত্যাগ করল।
অতুল্প্রসাদ-হেমের বিয়ে হল বিলেত গিয়ে কোন এক গির্জায়। তাঁদের দুটো যমজ-সন্তান হয়েছিল। কিন্তু গায়কের পরিস্থিতি দিন দিন মন্দের দিকে গতি করে। তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। আইনের পসার জমছিল না। পরে ধীরে ধীরে অবস্থার যদিউ উন্নতি হয়েছে, ঠিক সে মুহূর্তে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। যখন বিধবা মা অতুলপ্রসাদের সঙ্গে বসবাস আরম্ভ করলেন। শাশুরি-বৌয়ের ঝগড়া চরমে ওঠে। হেম কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না বিধবা শাশুড়িকে।
এভাবেই দিনের দিনের পর দিন আগুনে পুড়ছিলেন অতুলপ্রসাদ। মাঝে মাঝেই মন জুড়ানোর জন্যে তিনি চলে যেতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে শান্তিনিকেতনে।
অতুল প্রসাদ অসুস্থ। খবর ছড়িয়ে গেল চারদিকে। সব সম্প্রদায়ের মানুষজন এলেন প্রিয় অতুলবাবুকে দেখতে। এলেন না কেবল হেমকুসুম।
সকলকে উৎকন্ঠায় রেখে রাত একটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে আজকের দিনে এই মহৎপ্রাণ পঞ্চভূতে বিলিন হয়ে গেল।
শেষে খবর পেয়ে রাত দুটোয় এলেন হেমকুসুম। তাঁকে বলা হল ‘আপনি অসুস্থ মানুষ গাড়ী থেকে নেমে আর কি করবেন, সবইতো শেষ। ফিরে যান।’ মর্মর মূর্তির মত নিষ্পন্দ হেমকুসুম রাতের অন্ধকারে ফিরে চললেন।