আজ ১২ জানুয়ারি। এক মহতাত্মা স্বামী বিবেকানন্দের জন্মক্ষণ, আরেক মহতাত্মা মাস্টারদা সূর্য সেনের প্রয়াণক্ষণ।
সূর্যকুমার সেন যিনি জগতের মানুষের মুখে মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত। ডাকনাম কালু। ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাস্টারদার আজ ৮৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী।
পূর্ববঙ্গে জন্ম নেওয়া এই বাঙালি বিপ্লবী তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
সূর্যসেন এক মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম। ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনার জন্য তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। মাস্টারদা নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। বিপ্লবী বীর মাস্টারদা সূর্যসেন জন্মেছিলেন ১৮৯৪ সালের ২২ মে।
নিজের জীবন তুচ্ছাতিতুচ্ছ হয় প্রত্যেক মহৎ আত্মার কাছে।
সূর্য সেনের অন্যতম সঙ্গী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায় “কে জানতো যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপি অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ! কে জানতো সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে – তার সমস্ত ক্ষমতাকে উপহাস করে বৎসরের পর বৎসর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?”
চট্টগ্রামের জনসাধারণ বলত টাকা দিয়ে সূর্য সেনকে ধরা যায় না | তাই তো তাঁকে ধরিয়ে দেবার জন্যে ব্রিটিশরা হাজার হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেও কেউ তাঁকে ধরিয়ে দিতে চায়নি | দিনের পর দিন মাস্টারদা চট্টগ্রামে আত্মগোপন করে বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিচালনা করে গিয়েছেন | যদিও নেত্র সেন পুরস্কারের লোভে মাষ্টারদাকে ধরিয়ে দিয়েছিল | কিন্তু এর তিনদিন পরেই নেত্র সেনকে হত্যা করেছিলেন তাদের পরিবারের ছোট ছেলে কিরণ সেন | দীর্ঘদিন পুলিশি জেরার পরেও নেত্র সেনের স্ত্রী মুখে আনেননি কিরণ সেনের নামে |
মাস্টারদা তিনি যিনি প্রথম বুঝেছিলেন দেশের মেয়েরাও স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা নিতে পারে | মাস্টারদাকে প্রীতিলতা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘মেয়েদের আপনারা দলে নিতে চাইতেন না কেন দাদা? তাঁরা কি দেশসেবার যোগ্য নন?’’ মাস্টারদা জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘না, দেশসেবার কঠিন কর্তব্য থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা চলে না। দেশসেবায় নরনারী ভেদ নেই।’
১৯৩০ সালের এপ্রিল মাস | জালালাবাদ পাহাড়ে যুদ্ধের পর মাস্টারদা গেরিলা পদ্ধতিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন| এই সময় কলকাতা থেকে সুভাষচন্দ্রের দাদা প্রখ্যাত ব্যারিস্টার শরৎ বোস বিপ্লবীদের পক্ষে মামলা পরিচালন করতে ছুটে এসেছিলেন চট্টগ্রামে | শরৎ বোস মাস্টারদার কাছে গিয়ে বললেন যে তিনি মাষ্টারদাকে এমন জায়গায় পাঠিয়ে দিতে পারেন যেখানে তিনি ইংরেজদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারেন| জবাবে মাস্টারদা বললেন চট্টগ্রাম তিনি এক মুহুর্তের জন্যেও ছাড়তে পারবেন না| যেসব বিপ্লবীরা তার নির্দেশে জালালাবাদ পাহাড়ে, কালার পোলে লড়াই করে যাচ্ছে, যারা জেলে বন্দি হয়ে ইংরেজদের কাছে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করছে, তারা সকলে অপেক্ষা করছে মাস্টারদা কি করে তা দেখার জন্যে। তিনি চিরবিদ্রোহী, বিপ্লব তার রক্তে| দেশের জন্যে তিনি প্রাণ দিতে পারেন কিন্তু চট্টগ্রাম তিনি ছাড়তে পারবেন না।
মৃত্যুর আগে কি করা হয়েছিলো বিপ্লবী সূর্য সেনের সাথে ? পিটিয়ে শরীরের সমস্ত হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিলো ৷ ভারী কিছু দিয়ে বেদম আঘাত করে ভেঙে ফেলা হয়েছিলো বিপ্লবীর স দাঁত ৷ উপড়ে ফেলা হয়েছিলো হাত ও পা এর সমস্ত নখ ৷ তৎকালীন বৃটিশ সরকার এমনই বর্বর আচরণ করেছিলো তাঁর সাথে ৷ এমন কি মৃত্যুর পর তার দেহ তুলে দেওয়া হয়নি পরিজনদের হাতে ৷ ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিলো সমুদ্রের বুকে, ঠিক যেভাবে আমরা ছুঁড়ে ফেলি কোনো আবর্জনাকে ডাস্টবিনে, তেমনভাবে ৷
এ বেদনা কোথায় রাখি?
মাস্টারদার নেতৃত্বেই চট্টগ্রামে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ‘চট্টগ্রাম স্বাধীন জাতীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করা হয়। হতে পারে তিন/চার দিনের জন্য, তবু মাস্টারদারা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, মাস্টারদার বিস্ময়ে থমকে গিয়েছিল ভারতবর্ষ | রক্তে দোলা দিয়েছিল.. হ্যাঁ .. আমরাও পারি।
আজকের দিনেই ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল মাস্টারদার। ক্ষত-বিক্ষত সোনালী স্বপ্নের সেই পাথর বুকে নিয়ে বঙ্গোপসাগরের তলায় সমাজে সূর্যোদয় করে ঘুমিয়ে আছেন সূর্য সেন।
সে প্রস্তরের উপর গড়ে উঠেছে স্বাধীন ভারতের ভিত্তি।
ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম।