করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিধ্বস্ত পৃথিবীতে আজ পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৩৩ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে আসছে দিনটি। তবে এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মারণ করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব লড়াই করে যাচ্ছে। মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সর্বদিক দিয়ে। কিন্তু টালমাটাল হয়ে গেছে পৃথিবী। বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারিয়ে অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, পরিবারের মুখে দু-মুঠো অন্ন তুলে দেয়ার জন্যে তাদের ফিরতে হচ্ছে কল-কারাখানায়, কর্মক্ষেত্রে। ঠিক এমন একটি সময়ে বিশ্ববাসী পালন করতে যাচ্ছে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক দিন ‘মহান মে দিবস’। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস এই দিনটি মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠারও দিন। শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটারও দিন এটি।
শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ের এক ঐতিহাসিক দিন।
এই দিবসের পেছনে রয়েছে মর্মান্তিক এক কাহিনী। সপ্তদশ শতকের গোড়া থেকে বিশ্বজুড়ে শিল্পায়নের বিপ্লব শুরু হলে তা সার্থক রূপদানের পথে মূল কারিগর হিসেবে ছিলেন বিভিন্ন দেশের মেহনতি শ্রমিক। তবে সভ্যতার ক্রমবিকাশের হাত ধরে বিশ্বের আনাচেকানাচে যখন একের পর এক উঁচু দালান, মিল-ফ্যাক্টরি গড়ে উঠছিল তখন এর নেপথ্যের কারিগর-শ্রমিকদের অবস্থা ছিল একেবারে শোচনীয়। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা করে কাজ করতে হত। বিপরীতে মজুরি মিলত নগণ্য, শ্রমিকরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করত। মালিকপক্ষের এই নির্দয় আচরণই শ্রমিকদের মনে আন্দোলনের দাবানল জ্বালিয়ে দেয়।
১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রা, যেটি পরবর্তীতে শ্রমিক আন্দোলন জোরদারের পটভূমি তৈরি করে। কারখানা মালিকদের ক্রমাগত অন্যায়ের প্রতিবাদে ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক কর্মদিবস ৮ ঘণ্টা করার দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন এবং তা কার্যকরের সময়সীমা হিসেবে ১৮৮৬ সালের ১ মে বেঁধে দেন। দাবি মেনে না নেওয়ায় ঐ দিন আগস্ট স্পিজ নামের এক শ্রমিক নেতার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর হে-মার্কেট বাণিজ্যিক এলাকায় মিছিলের উদ্দেশ্যে জড় হন অসংখ্য শ্রমিক। দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমদিনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে মোট ১১ জন শ্রমিক নিহত হন। শ্রমিকদের উপর নির্যাতন এখানেই থেমে থাকেনি। হত্যা মামলায় আগস্ট স্পিজসহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে একজন শ্রমিক জেলে আত্মহত্যা করেন। শ্রমিকদের প্রতি এই নির্যাতন পরবর্তী কয়েক বছর বহাল থাকে।
১৮৮৯ সালে ১ মে হে-মার্কেটে বর্বরভাবে নিহত শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্যারিসে সমাজতন্ত্রী ও শ্রমিক পার্টি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ১৮৯০ সালের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কংগ্রেসে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে বিশ্বের অনেক দেশে দিনটিকে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
আজকের এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে শ্রমিক হয়ে দিন-রাত শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন করোনা রোগিকে চিকিৎসকরা। ২৪ ঘন্টা পিপিই গায়ে পড়ে অনন্ত ত্যাগ স্বীকার করে, সে সময়টুকু নিজেদের পেটে একফোঁটা জলও না দিয়ে সেবা করছেন! তাঁদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।