দরজায় কড়া নাড়ছে শারদোৎসব। আর তিন দিন বাদেই মহালয়া। অশুভ অসুর মহিষাসুরকে পরাজিত করে দেবী দুর্গা শুভ শক্তির জয়ের সূচনা করেছেন। আর এই বিজয়ের কথা মনে করিয়ে দিতেই আমাদের কাছে ‘মহালয়ার’ শুভ দিন। এই দিনটি আমাদের সবাইকেই মনে করিয়ে দেয় শুভ শক্তির জয়, অশুভ শক্তির পরাজয়ের কথা।
মহালয়ার দিনটি দেবীপক্ষের সূচনা এবং পিতৃ পক্ষের সমাপ্তি চিহ্নিত করে। অনেকেই পিতৃপক্ষকে অশুভ বলে মনে করেন, কারণ এই সময়ে পূর্বপুরুষদের আত্মার তৃপ্তির জন্য তর্পণ করা হয়। তবে এই ধারনা একেবারেই ভুল, কেননা আমাদের পূর্বপুরুষদের কষ্ট, ত্যাগ, বলিদানের ফসলই আমরা যারা পরবর্তী প্ৰজন্ম রয়েছি জীবনটাকে সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারছি। তাঁরা আমাদের জন্য সুন্দর শিক্ষা, আদর্শ দিয়ে গেছেন বলেই আমরা বর্তমানে বেঁচে আছি। জীবনটাকে ভালো মন্দ যাই আসুক উপভোগ করছি। তাঁরাই আমাদের জীবনের খারাপ সময় মোকাবিলা করার শিক্ষা দিয়েছেন। বাঁচতে শিখিয়েছেন। পূর্বপুরুষের অস্তিত্ব আমরা বর্তমান প্ৰজন্ম। তাই ধর্মীয় বিশ্বাস মতে তাঁদের আত্মা শান্তি থাকলে তৃপ্তি থাকলে আমাদেরও মনেও শান্তি থাকবে।

ছবি, সৌঃ আন্তর্জাল
তিল-জল দিয়ে পূর্বপুরুষের আত্মার তৃপ্তিসাধনকেই হিন্দুধর্মে বলা হয় তর্পণ। Mahalaya-র ভোরে নদীতে জলে তর্পণ দিয়ে তাঁদের শ্ৰদ্ধা জানিয়ে স্মরণ করা হয়। জীবনের ওপারে আমাদের পূর্বপুরুষরা ভালো থাকলে তৃপ্তি থাকলে সেটা ভেবে আমাদের মনও ভালো থাকে। তর্পণ শুধু পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যেই নয়, সর্বভূতের উদ্দেশেই করতে হয়। তর্পণের মন্ত্রের ভিতরই নিহিত রয়েছে সেই নির্দেশ-
আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তং দেবর্ষিপিতৃমানবাঃ।
তৃপ্যন্ত পিতরঃ সর্বে মাতৃমাতামহোদয়ঃ।।
আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তং জগৎ তৃপ্যতু।
আসলে মহালয়া হচ্ছে তিথি, পিতৃপূজা আর মাতৃপক্ষের সন্ধিলগ্ন। মহালয়া থেকেই শারদোৎসবের বার্তা আকাশে বাতাসে বয়ে আসে।
কথিত আছে শ্ৰীরামচন্দ্ৰ লংকা জয়ের আগে তর্পণ করেছিলেন। সেখান থেকেই আসে তর্পণের ভাবনা। তর্পণের মূল কথা হল তৃপ্তিদান। পিতৃতর্পণের মাধ্যমে পিতৃপুরুষের প্ৰতি শ্ৰদ্ধা ও প্ৰণাম নিবেদন। ভগবান, ঋষি ও পূর্বপূরুষদের আত্মাকে জল নিবেদন করে তাঁদের আত্মাকে সন্তুষ্ট করা হয়। বেশির ভাগ মৃৎশিল্পী এদিনই মা দুর্গার চক্ষুদান করেন। ব্ৰাহ্মমুহূর্তে ভোর ৪টে। মহালয়ার ভোরেই মায়ের চক্ষুদান করা হয়।
তবে যদি বিজ্ঞান ভিত্তিক মনোভাব নিয়ে বলা হয় তাহলে বিজ্ঞান বলছে একজন মানুষের মৃত্যুর পর আত্মা বলে কিছুই থাকে না। তবে এই প্ৰতিবেদনে সেদিকে যাচ্ছি না।

ছবি, সৌঃ আন্তর্জাল
মহালয়ার প্রকৃত বার্তা হচ্ছে সার্বজনীন উদারতা। যার সাহায্যে তৃপ্তি হয় তাই তর্পণ। ধর্মীয় বিশ্বাস মতে দেহ বিলীন হলেও, আত্মা অবিনশ্বর-পৃথিবীর সব ধর্মেই আছে এর স্বীকৃতি।
Mahalaya, শরতকালের কাকভোরে, ৪টে বাজতে না বাজতেই এখনও বাংলার ঘরে ঘরে বেজে ওঠে বীরেন্দ্ৰ কৃষ্ণ ভদ্ৰের কন্ঠ। শিশির ভেজা বাতাস সেই শব্দ বয়ে নিয়ে ছড়িয়ে দেয় দূর দূরান্তরে। ঘুম ভাঙে মঙ্গল শঙ্খের ধ্বনি আর আগমনির সুর আর চণ্ডীপাঠে। শুরু হয়ে যায় দেবীপক্ষ। রেডিওয়ে মহিষাসুরমর্দিনী শুনে এখনও বাঙালির মনে কেমন যেন একটা দোলা দেয়। চারদিকে আনন্দধারা বয়ে নিয়ে আসে মহালয়া। মনে প্ৰাণে আনন্দের ছোঁয়া লাগে। শিউলি ফুলের ঘ্ৰাণ আর নতুন জামাকাপোড়ের গন্ধে ৮ থেকে ৮০ সকলেরই নেচে ওঠে মন প্ৰাণ।