পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার আর জীবনযাত্রায় সাধারণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদক্ষেপই হল সুস্থ নিরোগ শরীরলাভের সহজতম উপায়।

’’চাই বল, চাই স্বাস্থ, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু, সাহস বিস্তৃত বক্ষপট।’’
আমাদের সকলেরই একেবারে মনের কথা। তবে সার্বিকভাবে সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকতে হলে এমনভাবেই জীবন যাপন করা উচিত যাতে আমাদের শরীর তার প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য সবরকমের পুষ্টি আমাদের রোজকার খাবারের মাধ্যমে যথেষ্ট ভাবে লাভ করতে পারে। সেইসঙ্গে দৈনিকশরীরচর্চা এবং পর্যাপ্ত ঘুম এইসব যথাযোগ্যভাবে মেনে চলাটাই সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্ত। আমরা সবাই জানি টকজাতীয় ফল বা vitamin C tablets খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো আর এতে অসুখ হলে তার থেকে তাড়াতাড়ি সেরে ওঠা যায়।তবে এখানে আমরা চোখ, হার্ট, হাড়, দাঁত, এবং আমাদের শরীরের ইমিউনিটি সুস্থ সবল রাখার জন্য আরও কি কি ভিটামিন ও নিউট্রায়েন্টসের প্রয়োজন হয় ও সেগুলি কোন কোন খাবার থেকে পাওয়া যায় সেইসব বিষয়ে আলোচনা করব।
সাধারণত চোখের কি কি সমস্যা হতে পারে এবং চোখ সুস্থ রাখার জন্য আমাদের কি করা উচিত?
চোখের কমন কয়েকটি সমস্যা হল:
● ড্রাই আই- ড্রাই আই হলে চোখে অস্বস্তিকর ইরিটেশন হয়, মনে হয় চোখে কিছু পড়েছে।
● ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে হওয়া এই ব্যাধিতে রেটিনার ব্লাড ভেসলস ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
● ক্যাটার্যাক্টস- বয়স হলে ধীরে ধীরে চোখের লেন্স ক্লাউডি বা ঝাপসা হয়ে যায় ফলে দেখতে অসুবিধা হয়।
● গ্লাউকোমা- এই ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে সাধারণত অতিরিক্ত আই প্রেশারের ফলে চোখ এবং ব্রেনের সংযোগকারী নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, গ্লাউকোমা অন্ধত্বও ডেকে আনতে পারে।
● ম্যাকিউলার ডিজেনারেশন- এই চোখের রোগে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। ম্যাকুলার ডিজেনারেশনে দৃষ্টির ক্ষেত্রের কেন্দ্র অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চোখের স্বাস্থের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু ফল যেমন
● পাতিলেবু, কমলালেবু, মুসাম্বিলেবু ইত্যাদি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল।
● কালোজাম।
● কলা।
● আম।
● পাকা পেঁপে।
চোখের স্বাস্থের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু সবজি যেমন
● ব্রকোলি।
● পালংশাক।
● মিষ্টিআলু।
● বেল পেপার।
● গাজর।
● অ্যাভোক্যাডো।
ভিটামিন এ, বি1, সি, এবং ই ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যেমন বিটা ক্যারোটিন, জিঙ্ক, লিউটিন, জিঅ্যাক্সানথিন এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড গুরুতর চোখের রোগ হওয়ার ঝুঁকি কম করে। এই ভিটামিনগুলি পাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হল নিয়মিত সুষম খাদ্য খাওয়া।
হার্টের কোন অসুখগুলো প্রায়ই হতে দেখা যায় আর সেগুলি প্রতিরোধ করতে কি কি খাবার খাওয়া ভালো?
প্রায়শই শোনা যায় হার্টের এমন কয়েকটি সমস্যা হল:
● করোনারি আর্টারি ডিজিজ (সি এ ডি)- এই অসুখে হার্টের প্রধান ব্লাড ভেসল প্লাক(plaque) তৈরি হওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফলে করোনারি ধমনীগুলো সরু হয়ে গিয়ে হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচল সীমিত হয়ে যায়।
● হার্ট অ্যারিথমিয়া- কার্ডিয়াক অ্যারিথমিয়ায় হার্টবিট অনিয়মিত হয়ে যায় কারণ এই ব্যাধিতে হার্টের বৈদ্যুতিক তরঙ্গের প্রবাহ অভিন্ন বা একরূপ থাকেনা।
● ডায়ালেটেড কাডিওমায়োপ্যাথি(ডি সি এম)- এই অসুখে হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠগুলি বড় হয়ে যায় এবং তাদের সংকোচনের ক্ষমতা হারায়।
● পালমোনারি স্টেনোসিস- এটি হার্টের ভালভের এক ধরনের রোগ যাতে পালমোনারি ভালভ সংকুচিত হয়ে যায়।
হার্টের পক্ষে স্বাস্থকর কয়েকটি সবজি এবং ফল:
● ব্লুবেরি, ব্ল্যাকবেরি এবং রাস্পবেরি।
● টমেটো।
● আপেল।
● অ্যাসপারাগাস।
● বেল পেপার।
● গাজর।
● রসুন।
● পেঁয়াজ।
আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে ফোলেট সহ ভিটামিন B6 এবং B12 সমৃদ্ধ খাবার খান। আপনার শরীরের সমস্ত পেশীর মতো, আপনার হৃদপিণ্ডের পেশীরও সংকোচন ও প্রসারণের জন্য ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের প্রয়োজন অপরিসীম।
হাড় ও দাঁতের অসুখগুলি কি কি আর মজবুত হাড় ও দাঁতের জন্য আমাদের কি করা উচিত?
হাড়ের কিছু সমস্যা যা সাধারণত দেখা যায়:
● অস্টিওপোরোসিস- এই অবস্থায় শরীরের হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যায়।
● অস্টিওআর্থ্রাইটিস(ও এ)- হাড়ের প্রান্তের নমনীয় টিস্যু ক্ষয়ে গেলে এই অসুখ হয়।
● অস্টিওমাঅ্যালিটিস- সংক্রমণের কারণে হাড়ে ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ, যা সাধারণত পা, বাহু বা মেরুদণ্ডে হয়।
● প্যাগেটস ডিজিজ অব বোন- এটি এমন একটি রোগ যাতে পুরোনো হাড়ের টিস্যুর জায়গায় নতুন হাড়ের টিস্যু তৈরিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। হাড়ের এই রোগটি সাধারণত পেলভিস, মাথার খুলি, মেরুদণ্ড এবং পায়ে দেখা যায়।
দাঁতের কয়েকটি অসুখ যা খুব দেখা যায়:
● দাঁতের ক্যারিস (দাঁতের ক্ষয়)- দাঁতের স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ অংশগুলি যা ছোট গর্তে পরিণত হয়।
● পিরিওডন্টাল (মাড়ি) রোগ- গুরুতর মাড়ির সংক্রমণ যা মাড়ির ক্ষতি করে এবং চোয়ালের হাড় ধ্বংস করে দিতে পারে।
● ইডেন্টুলিজম (সম্পূর্ণ দাঁতের ক্ষতি)- স্বাস্থবিধি মেনে না চলার কারণে মাড়ির রোগ, হাড়ের ক্ষয় হয়ে সব দাঁত অসময়ে পড়ে যায়।
● সেন্সিটিভ দাঁত- এই অসুখে দাঁতের এনামেল ক্ষয়ে যায় বা দাঁতের গোড়া উন্মুক্ত হয়ে যায়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দাঁতের সমস্যা প্রতিরোধযোগ্য এবং প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণভাবে সেরে যায়।
হাড় ও দাঁতের স্বাস্থরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু খাবার:
● দুধ, চীজ, ডেয়ারি প্রোডাক্ট।
● ব্রকোলি, বাঁধাকপি, ঢ্যাঁড়স।
● সয়াবিন।
● টোফু।
● বাদাম।
● ফর্টিফায়েড রুটি।
● প্রোটিনযুক্ত খাবার।
● ভিটামিন সি যুক্ত ফল- কমলালেবু, মুসাম্বি, কলা, পেঁপে, আনারস, পেয়ারা।
● ভিটামিন কে সমৃদ্ধ খেজুর, আঙুর, ডুমুর।
হাড় ও দাঁতের স্বাস্থরক্ষার জন্য ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ও প্রোটিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, ভিটামিন ডি মূলত আমরা সূর্যালোক থেকে পাই আর শরীরে অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামের জোগানের প্রয়োজন হলে অবশ্যই ডাক্তারের নির্দেশমতো calaium tablets খাওয়া জরুরি। সুগঠিত, শক্ত হাড়ের জন্য উপযুক্ত খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ওজন তোলার ব্যায়াম করুন যা আপনার শরীরকে অভিকর্ষের বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করে এবং শরীরের ওজন অবশ্যই সুস্থভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করবেন।
আমাদের শরীরের নিজস্ব রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখতে কি করতে হবে?
ইমিউন সিস্টেমের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে: এটি আপনার শরীরকে ক্ষতিকারক পদার্থ, জীবাণু এবং কোষের পরিবর্তন থেকে রক্ষা করে যা আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। এটি বিভিন্ন অর্গান, কোষ এবং প্রোটিন দিয়ে গঠিত। যতক্ষণ আপনার ইমিউন সিস্টেম মসৃণভাবে কাজ করে চলেছে, আপনি লক্ষ্যই করবেন না যে এটার কোন অস্তিত্ব আছে।
হোয়াইট ব্লাড সেলগুলিকে এক অর্থে ইমিউনিটি সেল বলা যায়, কারণ এগুলি রক্তপ্রবাহের মধ্য দিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াকে অনবরত প্রতিহত করে বিভিন্ন অসুস্থতা এবং রোগের হাত থেকে আমাদের শরীরকে রক্ষা করে।
প্রাথমিক ইমিউনোডেফিসিয়েন্সির লক্ষণ ও উপসর্গগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে ঘন ঘন এবং বারবার হতে থাকা
● নিউমোনিয়া,
● ব্রঙ্কাইটিস,
● সাইনাস সংক্রমণ,
● কানের সংক্রমণ,
● মেনিনজাইটিস
● ত্বকের সংক্রমণ।
● অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলির প্রদাহ এবং সংক্রমণ।
● রক্তের ব্যাধি, যেমন কম প্লেটলেট কাউন্ট বা অ্যানিমিয়া।
আপনার ইমিউনিটিকে শক্তিশালী করার স্বাস্থ্যকর উপায়:
● ধূমপান করবেন না।
● ফলমূল ও শাকসবজি বেশি পরিমাণে খান।
● নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
● স্বাস্থসম্মতভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
● অ্যালকোহল পান করলে শুধুমাত্র পরিমিত পরিমাণে পান করুন।
● পর্যাপ্ত ঘুম।
● সংক্রমণ এড়াতে পদক্ষেপ নিন, যেমন ঘন ঘন আপনার হাত ধোয়া এবং মাংস সঠিক তাপমাত্রা ও সময় নিয়ে রান্না করা।
ফোলিক অ্যাসিড, ভিটামিন বি6, ভিটামিন বি12 শরীরে হোয়াইট ব্লাড সেলস তৈরি করতে সাহায্য করে। ভিটামিন সি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস, এটি শরীরের ইমিউন সিস্টেমের একাধিক সেলুলার ফাংশনকে সাহায্য করে আপনার ডিফেন্স সিস্টেমে অপরিহার্য ভূমিকা নেয়।
ভিটামিন সি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হওয়ার কারণে শরীরের ফ্রি র্যাডিক্যালের সাথে লড়াই করতে পারে, যার ফলে প্রদাহ বা ইনফ্লেমেশন কমিয়ে দেয় এবং ইমিউনিটি বাড়ায়। ভিটামিন সি আমাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে শরীরকে টক্সিনমুক্ত হতে সাহায্য করে। তাই দৈনিক খাদ্যতালিকায় এইগুলি যোগ করলে শরীরের ইমিউনিটি বাড়াতে ও বজায় রাখতে সাহায্য করে:
● কমলালেবু ।
● পাতিলেবু।
● মুসাম্বি।
● তেঁতুল।
● কলা।
● ওমেগা3 সমৃদ্ধ ফ্যাটি মাছ।
● রসুন।
● আদা।
● হলুদ।
● ব্রকোলি।
● বেলপেপার।
● সূর্যমুখী বীজ।
● রাঙালু।
● রঙিন মুলো।
● পালংশাক।
● অ্যামন্ড বাদাম।
● পাকা পেঁপে।
● গ্রিন টি।
বেশিরভাগ সিট্রাস ফলে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন সি থাকে, যা আপনার শ্বেত রক্তকণিকা বাড়িয়ে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। সবুজ শাক সবজিতে উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি এবং ভিটামিন কে, পাশাপাশি বিটা ক্যারোটিন, ফোলেট এবং ফাইবার রয়েছে, এগুলি শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধক।
উপসংহার
সুস্থ, নিরোগ শরীর নিয়ে জীবন উপভোগ করতে চাইলে অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হল প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলস এবং আরও অন্যান্য পুষ্টিগুণে ভরপুর সুষম খাবার প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণে খাওয়া, নিয়মিত শরীরচর্চা করলে সুস্থ তো থাকবেনই সেইসঙ্গে ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকবে ফলে অনেক অসুখবিসুখকে আগে থেকেই প্রতিহত করে রাখা সম্ভব হবে।
ইমিউন কোষের বৃদ্ধি এবং কার্যকারিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা পুষ্টির উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি, জিঙ্ক, সেলেনিয়াম, আয়রন এবং প্রোটিন (অ্যামিনো অ্যাসিড গ্লুটামিন সহ)। আমাদের শরীরের স্বাভাবিক ইমিউনিটি বজায় রাখতে এবং শক্তিশালী করতে আপনার ডাক্তারবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী vitamin C tablets খেতে পারেন।
শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম আছে এমন ব্যক্তিদের আঘাত বা অসুস্থতা থেকে দ্রুত সেরে ওঠার সম্ভাবনা বেশি, এরা কম ক্লান্তি বোধ করে এবং এদের অন্ত্রের স্বাস্থ্যও(গাট হেল্থ) খুব ভালো থাকে এককথায় সার্বিকভাবে সুস্থ থাকে।