“প্রতিবছর আমি তরুণ হয়ে উঠি”! আত্মজীবনীতে অমূল্য এই কথাটি লিখেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তী পরিচালক মৃণাল সেন। ‘তরুণ’ তিনটি অক্ষরের একটি শব্দে বিরাট আশা-ভরসা-তেজ-বীরত্বের বীজ বপন হয়ে আছে। বাংলা সাহিত্যে ‘রসুন’ যদি একসঙ্গে বলি, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ, কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, নজরুল ইসলাম সবুজের-যৌবনের-জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন।
মনের মৃত্যুতেই দেহের মৃত্যু! বর্তমান কোভিড-১৯ এর এই সংকটময় সময় পৃথিবীর মানবজাতিকে বারবার মৃণাল সেনের মতোই বলতে হবে “প্রতিবছর আমি তরুণ হয়ে উঠি”।
আজ ১৪ মে’ প্রবাদ প্রতিম চিত্রপরিচালক মৃণাল সেনের ৯৭’তম জন্মবার্ষিকী।
বাংলা চলচ্চিত্রে তৈরি হয়েছিল তিনটে ঘরানা ৷ এক সত্যজিৎ, আরেক ঋত্বিক এবং তিন মৃণাল সেন ৷ এই তিন পরিচালকের ছবি তৈরির ঘরানার মধ্যে পার্থক্য অনেক ৷
কেউ চলচ্চিত্র পর্দায় সাহিত্য থেকে ধার করে, নন্দন তত্ত্বের ওপর ভর করে বাস্তবকে তুলে নিয়ে আসতেন। আবার কেউ ছবির পর্দায় গল্পের মাধ্যমে অনবরত সমালোচনা করেই চলত সমাজের ৷ প্রথমজন যদি সত্যজিৎ রায় হন, তাহলে দ্বিতীয়জন অবশ্যই বিখ্যাত নাট্যকার ঋত্বিক ঘটক ৷
অন্যদিকে সত্যজিৎ রায় এবং ঋত্বিক ঘটকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছুটা দূরে সরে সিনেমাকে অন্যভাবে দেখেছেন পরিচালক মৃণাল সেন। কখনও যদি কঠোর বাস্তব হয়, কখনও আবার মানুষের মন থেকে স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নকে নিংড়ে, শুষে নিয়ে মৃণালবাবু পর্দায় তৈরি করতেন এক অদ্ভুত ছবি ৷ এবং তাই হয়তো, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের পাশাপাশি সিনেমার পর্দায় নিজের ভিন্ন ‘অটিয়োর’ সৃষ্টি করেছিলেন মৃণাল সেন ৷
মূলত ‘গণ’ অর্থাৎ সাধারণ মানুষ, গণনাট্যই মৃণাল সেনকে ‘মৃণাল সেন’ করে তুলেছিল। তিনি বলেছিলেন, গণনাট্যের জন্যই দেশের মাটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন ৷ গ্রামগঞ্জের ভিতরে ঢুকে মাটির সেই আসল জীবন তিনি দেখেছেন ৷ দেখেছেন মানুষের হাড়ভাঙা লড়াই ৷ মানুষগুলোর যাপিত জীবন। আর এই অভিজ্ঞতাগুলোকে ঝুলিতে ভরে তিনি নির্মাণ করেছেন একের পর এক ছবি। এক-একটি এসেট ৷
১৯৫৫ সালে মৃণাল সেন তৈরি করেছিলেন প্রথম ছবি ‘রাতভোর’ ৷ কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েছিল সেই ছবি ৷ কিন্তু অসফলতাতেই আটকে থাকবেন কেন দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ? তিনি তো বিশ্বাস করেন ‘I am one year younger than what I’ll be in next year’! আর দেরি হলো না তাই। তৈরি করে ফেললেন ‘নীল আকাশের নিচে’ নিজের জায়গা।
মানুষ মৃণাল সেন এমন একজন পরিচালক ছিলেন, যিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন সিনেমা শুধুই বিনোদনের জন্য নয়, সিনেমার মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষিত করে তোলাও যায়।
মৃণাল সেনের সৃষ্টির ঝুলিতে রয়েছে ‘ভুবনসোম’, ‘কোরাস’, ‘মৃগয়া’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘পুনঃশ্চ’, ‘পরশুরাম’, ‘একদিন প্রতিদিনে’র মতো অসামান্য সব ছবি। তাঁর শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’ (২০০২)। সর্বমোট ২৭টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি, ১৪টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ও ৪টি তথ্যচিত্রের পরিচালনা করেছিলেন মৃণাল সেন।