কলকাতা: অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়কে কে না চেনেন? কিন্তু জানেন কি অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়র জীবন মোটেও সুস্থ ছিল না। তিনি চরমভাবে নেশায় আসক্ত ছিলেন। নেশা ছাড়া একটা সেকেণ্ড তাঁর চলত না। সেই মানুষ কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে গেলেন! তিনি বিশাল উদাহরণ।
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় ফেসবুকে লিখেছেন:
“আজকে ২২শে জানুয়ারি । কালকে আমার জন্মদিন । এই জন্মদিনটাই আমার সবচেয়ে কাছের । কেন ?? কারণ কালকে আমার নেশামুক্তির ১৫ বছর ।
২৯শে ডিসেম্বর তো বায়োলজিক্যাল বার্থডে। কিন্ত কালকের দিনটা আমার কাছে অনেক অনেক বেশি স্পেশাল । আমার কাছে এখনও জলের মতো স্পষ্ট ২০০৮ সালে আজকের এই দিনটা ।
আর দেখতে পাই বলেই হয়তো আজকে এটা লিখতে পারছি । ব্যাঙ্কসাল কোর্টে হাজিরা দিয়ে আমাকে রিহ্যাবে ফিরতেই হতো । ৯টার বনগাঁ লোকাল আর আমাকে যেতে হত হাবড়া ।
সাথে ছিল শেষবারের মতন নেশা করবো বলে একটু ব্রাউন সুগার, পাতি বাংলায় কয়েকটা পাতা আর একটা সিরিঞ্জ, একটু তুলো একটা চামচ । হাবড়া স্টেশনে নেমে একটু এগোলেই সেই রিহ্যাব যেখান থেকে আমার ভালো থাকার লড়াই শুরু হয়েছিল ।
তার আগে প্রায় ২৮ বা ২৯ টা ডিটক্স আর রিহ্যাব হয়ে গেছে । যেদিন ছাড়া পেতাম সেদিনকেই রিলাপস, এরম একটা প্যাটার্ন ছিল । আমাদের ভাষায়ে আমরা বলি ক্রনিক রিলাপসী । ৬/৭ বছর ধরে অনবরত ঘুরতে থাকা একটা বৃত্ত ।
নয় বাইরে নেশা করছি নয় তালা চাবির ভিতরে ভালো আছি । তালা চাবির বাইরে বেরোলেই আবার নেশা । না নিজে বিশ্বাস করতাম যে আমি কোনোদিন ভালো হতে পারবো না আমাকে কেউ বিশ্বাস করতো যে আমি কোনোদিন নেশা ছেড়ে দেবো ।
উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারের আর কতই বা ক্ষমতা ? বাড়ির সব কিছুই মোটামুটি ততদিনে প্রায় শেষ । সে মায়ের সোনার গয়না হোক বা বাবার সঞ্চয় । এরপরে বাইরের লটরবহর তো আছেই । লোহা, অ্যালুমিনিয়াম,কাঁসার জিনিস তখন আমার কাছে সোনার মতনই দামী । যে কোনো গাড়ির লক খুলতে লাগতো ঠিক তিন মিনিট ।
একটা নোকিয়ার মোবাইল মানে ক্যাশ ২/৩ হাজার । সেটাই অনেক তখন আমার কাছে । এরম একটা সময় আমি আমি বুঝতে পারছিলাম এভাবে যদি চলতে থাকে আমি ২৮ বছর অবধিও টানতে পারবো না আর চোখের সামনে চারটে ইউজিং পার্টনার কে পরপর মরতে দেখে একটু ভয়ও পেয়েছিলাম ।
এতটাই বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিলাম যে আমার সেই রিহ্যাবে যাওয়া আর সেখানে আবার কয়েকমাস চার দেওয়ালের মধ্যে থাকা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। যদি থাকতো তাহলে আরো কয়েকদিন টানতে পারতাম । কিন্তু পারিনি । আর এই উপলব্ধিটাই আমাকে একটু হলেও সাহস যুগিয়ে ছিল।
এভাবেই আমার ভালো থাকার শুরু । শুরুটা সত্যি কঠিন ছিল । না কেউ বিশ্বাস করতো, না নিজে বিশ্বাস করতাম যে নেশা করা ছেড়ে দেবো । জীবনের ধ্যানজ্ঞান ভালোবাসা তো ছিল একটাই, নেশা। ওটাকে আকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম আর নেশা আমাকে মারতে চেয়েছিল ।
আমি সেদিন নেশার কাছে হেরে গেছিলাম । আর হেরে গেছিলাম বলেই হয়ত আজকে আমি জিতছি । আজকে যখন রাস্তায় লোকে সেলফি তুলতে চায় , অটোগ্রাফ চায় , ভালোবাসা দেয় তখন আমি নিজেকে দেখি আর পুরোটাই কেমন স্বপ্নের মতন লাগে ।
আদৌ এটা সত্যি হচ্ছে তো ? কোথায় সেই ছেলেটা আর কোথায় আজকের আমি । হয়তো আরো কিছু করতে পারতাম । হয়তো আরও একটু জীবনটা গোছাতে পারতাম , পারিনি কিন্তু সেটা নিয়ে আমার কোনো খারাপ লাগা নেই । যা আছে , যে টুকু সম্মান আর ভালোবাসা আমাকে সমাজ ফিরিয়ে দিয়েছে আমি সেটা নিয়েই খুশি ।
বাকিরা এগোক না, ক্ষতি কি আমার শুরু তো অনেক নিচ থেকে আর আমার লড়াইটাও একটু হলেও আলাদা, একটু হলেও কঠিন । আমার লড়াই সেই বাঁদরটার সাথে যে আজকেও আমার মধ্যে আছে । যাকে আমাকে প্রতিনিয়ত বশে রাখতে হয় । তার জন্যে যদি দামী গাড়ি বাড়ি একটু দেরি হয় , হবে ।
নাহলেও আমার কোনো আপত্তি নেই । মা চলে যাওয়ার আগে আমার নেশামুক্ত দেখে গেছে কিন্ত বাবা চলে যাওয়ার আগে আমার ঘুরে দাড়ানো প্রত্যক্ষ করে গেছে । গর্ব করে সবাইকে বলতো আমি অনিন্দ্যর বাবা । বোনের ও গর্ব আমি । আর কি চাই ?
এভাবেই এক একটা দিনের লড়াই আমার চলতে থাকুক । অভিনেতা বা সেলিব্রিটি অনিন্দ্য চাটার্জী তো আমি ফেসবুকে , শুটের লোকেশনে বা বাড়ির বাইরে বেরোলে। বাড়িতে আয়নার সামনে এখনও আমি সেই বাঁদর ছেলেটাই । ওকে দমিয়ে রাখতে পারলেই আমি বাকিটা সামলে নেবো । আমার উপলব্ধ ঈশ্বর আমাকে এভাবেই আমাকে আগলে রাখুক । আর ভালো থাকুক পৃথিবী । আমার কাছের মানুষগুলো । আমার বন্ধুরা । এটাই প্রার্থনা ।