একই দিনে মাত্র ৭ ঘন্টার ব্যবধানে চলে গেলেন এপার-ওপার বাংলার দুই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সাহিত্যিক দেবেশ রায় এবং শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান!
রেখে গেছেন দেশভাগের রক্তাক্ত ইতিহাসের স্মৃতি!
হায়রে দেশভাগ!
“কোন দোষ ছিল না গো আমাদের
দেশ ভাগের
রাংতায় মোড়া তীর ধনুকে ফুলের টীপ
কেউ ছিল না আমাদের শ্রেণী শত্রু
আমরা তো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলিনি
আমাদের কোন দেশ ভাগ ছিলনা ।
তবু কেনো দেওয়া হলো কাঁটাতার ?
ভাগ হয়ে গেল মন ,জাতি ,সম্পদ।”
দেবেশ রায়-আনিসুজ্জামান দুজনেই দেশভাগের শিকার। দুজনেই ছিন্নমূল। একজন হিন্দু হওয়ার দায়ে, একজন মুসলমান হওয়ার দায়ে!
আনিসুজ্জামানের জন্মস্থান বসিরহাট, পশ্চিমবংগ। দেবেশ রায়ের জন্ম পূর্ববংগের পাবনায়। দেবেশ রায়কে পূর্ববংগ ছেড়ে পশ্চিমবংগে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তিনি হিন্দু বলে। আনিসুজ্জামানকে পশ্চিমবংগ ছেড়ে পূর্ববংগে চলে যেতে হয়েছিল। তিনি মুসলমান বলে।
‘দেশ’ নামক বস্তুটির জন্য পৃথিবীর সমস্ত বাস্তুহারা ছিন্নমূল মানুষের নিরন্তর অন্বেষণ এবং তার ব্যর্থতার হাহাকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এটাও লক্ষ করার বিষয় যে, পূর্ব ভারতের দেশভাগ ও ভিটে থেকে উৎখাত-হওয়া হিন্দু শরণার্থীদের কাহিনি যেমন জটিল মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে-যাওয়া বাঙালি মুসলমানদের গল্প তেমনই জটিলতর। উভয় সম্প্রদায়ই স্বাধীনতার স্বাদ নিয়েছে এবং শরণার্থীও হয়েছে। এক জীবনে আশ্রয়চ্যুত হয়ে নোঙরহীন নৌকোর মতো অনিশ্চিতের পথে চলে নিজস্ব মাটি খোঁজার অভিজ্ঞতা ইতিহাসের কাছে কখনো কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। ব্যক্তি অনেক কিছুই ভুলতে পারে, কিন্তু ইতিহাসকে বিস্মৃতির দায় এড়াতে হয়।
বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন দুজনের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন। যদিও সমাজে, পৃথিবীর মানুষকে তাঁরা যথেষ্ট দান করেছেন, সবচেয়ে বড় কথা, সার্থক জীবন ছিল তাঁদের। তাই আমি তাঁদের মৃত্যুতে দুঃখ করছি না। তাঁদের জন্যে আমার দুঃখ, যাঁরা প্রতিভাবান হয়েও বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, উপেক্ষিত, অপমানিত, অবহেলিত রয়ে গেছেন সারা জীবন। বলছেন তসলিমা।
“দেশভাগের শিকার ছিলেন দুজনেই। আনিসুজ্জামানের জন্মস্থান বসিরহাট, পশ্চিমবংগ। দেবেশ রায়ের জন্ম পূর্ববংগের পাবনায়। দেবেশ রায়কে পূর্ববংগ ছেড়ে পশ্চিমবংগে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তিনি হিন্দু বলে। আনিসুজ্জামানকে পশ্চিমবংগ ছেড়ে পূর্ববংগে চলে যেতে হয়েছিল। তিনি মুসলমান বলে। দুজনই তাঁদের মুক্তচিন্তা, মননশীলতা,উদারনীতি, রাজনৈতিক আদর্শ, সর্বোপরি তাঁদের উপন্যাস এবং প্রবন্ধের জন্য শ্রদ্ধা, সম্মান, পুরস্কার যথেষ্ট পেয়েছেন। প্রায় একই বয়সে দুজন দু’দেশ থেকে চিরকালের জন্য বিদেয় নিয়েছেন গতকাল। যথেষ্ট বয়স হয়েছিল। যা দেওয়ার ছিল, দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, সার্থক জীবন ছিল তাঁদের। সে কারণে আমি তাঁদের মৃত্যুতে দুঃখ করছি না।
আমি তাঁদের মৃত্যুতে দুঃখ করি, জীবনে যাঁদের সুখ স্বস্তি সহানুভূতি সমর্থন পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পাননি। যাঁরা প্রতিভাবান হয়েও বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, উপেক্ষিত, অপমানিত, অবহেলিত রয়ে গেছেন সারা জীবন। যাঁরা কেবল ঠকেছেন, কেবল দুঃখ পেয়েছেন,কেবল দুঃখই পেয়েছেন। তাঁদের জন্য আমি অশ্রুপাত করি।”