ঢাকা: এদের বয়স কতো আর হবে হয়তো ৮/১০ বছর।কিন্তু তারা বুঝে গিয়েছে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত। তাই ওরা স্বদেশে ফিরে ভালোভাবে জীবনধারণ করতে চায়।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছে সারি সারি বস্তিঘর। বাইরে চোখ মেললে দেখা যায় সাগরের উচ্ছ্বল ঢেউ। তার মাঝে চলেছে নৌকা, কখনও ভেসে উঠছে ডলফিন, ঢেউ ভেদ করে চলা সেই নৌকার যাত্রীদের হাতে আবার জীবনের বই। মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত শিশু-কিশোরীরা এভাবেই নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর বাড়ি ফেরার স্বপ্ন আঁকলো রঙ-তুলিতে।
বাংলাদেশের (Bangladesh) নোয়াখালীর ভাসানচরে Rohingya শিবিরে ১৭০ ফুট লম্বা দেয়ালচিত্রে এমনই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। যেসব Rohingya কিশোর-কিশোরীরা কখনও রঙ-তুলি হাতে নেয়নি, একজন শিল্পীর সঙ্গে তারাই যোগ দিয়েছে সেই শিল্পকর্মের কাজে।
কমিউনিটি পর্যায়ে চিত্রকর্মের মাধ্যমে নানা গল্প তুলে ধরা প্রতিষ্ঠান আর্টোল্যুশনের কার্টুনিস্ট সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময় এ দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের উৎকণ্ঠার জীবন আর দেশে ফেরার ব্যাকুলতা তুলে ধরেছেন।
রাষ্ট্রসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশনের (ইউএনএইচসিআর) বাংলাদেশ দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সম্প্রতি ভাসান চরে আশ্রিত শরণার্থীদের সঙ্গে তিনি দেখা করেন। তাদের জীবনের গল্প শোনেন।
আর মায়ানমারের (Myanmar) রাখাইনে তাদের নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখতে পান।
তন্ময় বলেন, “ভাসানচরের Rohingya কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের হাতে রঙ তুলি তুলে দিয়েছিলাম আমরা। তখন দেখা গেল তারা বেশিরভাগই নৌকা বা অন্যান্য পরিবহনের ছবি আঁকছে।
নৌকা আঁকার কারণ জিজ্ঞেস করায় তারা জানালো, নৌকায় চড়ে কেউ মায়ানমারে নিজ বাসভূমি ফিরতে চায়, আবার কেউ কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে ফেলে আসা তাদের স্বজনদের কাছে যেতে চায়। তাই তাদের মানসপটে নৌকাটাই সবার আগে ভেসে আসে।”
সংবাদ সম্মলেনে জানানো হয়, আর্টোল্যুশন কক্সবাজারেও ১৭টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ইতিবাচক পরিবর্তনে কাজ করছে।
শরণার্থীরা এই ছবিগুলোর মাধ্যমে তাদের আত্মপরিচয়, তাদের দুঃসহ অতীত, বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছে। ভাসানচরে কাজ করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তন্ময় বলেন, “চিন্তা করুন কিছু শিশুর কথা, যারা জীবনে কখনও রঙ বা তুলি ধরেনি।
আবার ওরাই সবাই মিলে আমাকে সাহায্য করেছে ১৭০ ফুট দীর্ঘ পেইন্টিং শেষ করতে। এই ম্যুরালটিতে খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে শরণার্থীদের অর্থবহ জীবন, আত্মপরিচয় এবং মানসিক শান্তির সন্ধান।”
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করার সময় নিজের শিল্পকর্মের চেয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষদের সেখানে বেশি যুক্ত করার ওপর জোর দেওয়ার কথা জানান কার্টুনিস্ট তন্ময়।
এসব চিত্রেকর্মে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যুক্ত করায় তাদের চাহিদা, কষ্ট, আশা ও স্বপ্নের কথা সেখানে উঠে এসেছে। আমরা যে ১৭০ ফুট দীর্ঘ চিত্রটি এঁকেছি সেখানে উদ্বাস্তু মানুষেরা তাদের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, আশা-আকাঙ্ক্ষা ফুটিয়ে তুলেছে।
আমরা শুধু তাদের মধ্যে সেই আশার স্বপ্নটা জ্বালতে সাহায্য করেছি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে সেই চিত্রকর্মটি তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। তার মধ্যে একটি অংশ রোহিঙ্গাদের শিক্ষা আর বাল্যবিবাহ নিয়ে।
কার্টুনিস্ট তন্ময় বলেন, “আমি রোহিঙ্গা নারীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের কখন বিয়ে হয়েছে। কেউ সত্যিটা বলছিল না। একটা সময় যখন বলতে শুরু করে তখন দেখা যায়, কারও বিয়ে হয়েছে ১৩ বছরে, কারও ১২ বছরে।
তখন আমি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি পড়াশোনা একজন নারীকে মুক্তি দিতে পারে। চিত্রকর্মটি আঁকার সময় দেখা যায় এক রোহিঙ্গা কিশোরী বইকে তার ডানা হিসেবে তুলে ধরেছে।
পুরো চিত্রকর্মটি এমনভাবে আঁকা হয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে মেয়েটি পড়ছে এবং কিছু হাত বিয়ের শাড়ি নিয়ে এসেও তাকে ধরতে পারছে না। বর্তমানে প্রায় ২৭ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী ভাসানচরে আছে, যার প্রায় ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু।