ঢাকা: বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা টানা ৩ দিনের অবরোধ মঙ্গলবার থেকে শুরু। মঙ্গলবার থেকে আগামি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিনদিন সারাদেশে সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি ও জামায়াত।
গত রোববার সন্ধ্যায় দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নতুন এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। অন্যদিকে যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে হরতালের পর এবার অবরোধেরও ডাক দিয়েছে দলটির সাবেক শরিক জামায়াতে ইসলামী।
তারাও মঙ্গলবার থেকে ৭২ ঘণ্টার সড়ক, রেল ও নৌ পথ অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির সিদ্ধান্ত আসার পর দিন সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাছুম এই সিদ্ধান্ত জানান।
বিএনপি-জামায়াতের অবরোধকে ঘিরে রাজধানীজুড়ে কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকাকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জানা গেছে, দেশে চলমান বিচারহীনতা, অপশাসন, সীমাহীন দুর্নীতি, অনাচারম অর্থ পাচার ও সিন্ডিকেটবাজীর ফলে দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতিতে বিপর্যস্ত জনগণ।
তাদের জীবন জীবিকা রক্ষার স্বার্থে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আয়োজিত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে হামলা, নেতা-কর্মীদের হত্যা, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আন্দোলরত বিভিন্ন দলের সহস্রাধিক নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি, হয়রানি ও নির্যাতনের প্রতিবাদে মঙ্গলবার থেকে আগামি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা তিনদিন দেশব্যাপী সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। টানা তিন দিন সারা দেশে সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধ করবে বিএনপি।
অপরদিকে, সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাছুম বলেন, সরকারের পদত্যাগ, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আমিরে জামায়াত শফিকুর রহমানসহ গ্রেফতারকৃত সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আলেম-ওলামার মুক্তি, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি রোধ, ২৮ অক্টোবর বিরোধীদলের মহাসমাবেশে হামলা, সাংবাদিক ও নেতাকর্মীদের হত্যা এবং সরকারের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রতিবাদে আজ ৩১ অক্টোবর এবং ১ ও ২ নভেম্বর সারাদেশে সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের আগে আগে দলটি তার দেড় যুগের ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে জোটের সাবেক শরিকরা বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে যুগপৎ কর্মসূচি দিলেও জামায়াত ছিল ‘হাত গুটিয়ে’।
দুই দলের মধ্যে দূরত্বের বিষয়টি নিয়ে সে সময় গণমাধ্যমে নানা প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। তবে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপি ‘মহাসমাবেশের’ ডাক দিলে একই কর্মসূচি দেয় জামায়াতও। বিএনপিকে পুলিশ সমাবেশের অনুমতি দিলেও জামায়াতকে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি।
কিন্তু অনুমতি ছাড়াই দলটি রাজধানীর আরামবাগে জমায়েত করে এবং দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ দেন। সেদিন নয়া পল্টনে বিএনপির কর্মসূচির অদূরে কাকরাইল ও বিজয়নগর এলাকায় পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষের পর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা হয়।
এরপর সমাবেশ না করে বিএনপি দেয় হরতালের ডাক। এরপর জামায়াতও গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে একই কর্মসূচি দেয়। গত রোববার হরতাল শেষে বিএনপির পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সরকারের পদত্যাগ এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে মঙ্গলবার থেকে টাকা ৭২ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ঘোষিত অবরোধের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য আমি জামায়াতে ইসলামীর সর্বস্তরের জনশক্তি এবং দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। গত শনিবার বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে হাঙ্গামার জন্য আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী করেন তিনি।
তিনি বলেন, বিরোধীদলের শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হামলা করে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টিয়ারগ্যাস, গুলি ও বেধড়ক লাঠিচার্জ করে মহাসমাবেশ পণ্ড করে দেয়। পুলিশের টিয়ারগ্যাস এবং গুলির আঘাতে সাংবাদিক ও বিএনপির নেতাকর্মীসহ চার জন নিহত এবং কয়েক হাজার নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। মহাসমাবেশ ও হরতালকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিনে সারাদেশে জামায়াতসহ বিরোধীদলের প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের অভিযোগও আনেন এটিএম মাছুম।
এদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকা ৩ দিনের সড়ক-রেল-নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেও পণ্য ও যাত্রীবাহী পরিবহন চালানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।
গতকাল সোমবার বিকেলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহর পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মঙ্গলবার থেকে টানা ৩ দিন সারা দেশে সড়ক-রেল-নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির ব্যাপারে জরুরি আলোচনা করার জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মালিক-শ্রমিকদের যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বিএনপির ডাকা মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবারের অবরোধ উপেক্ষা করে ঢাকাসহ সারা দেশে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন চলাচল অব্যাহত থাকবে বলে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সে মোতাবেক আজ মঙ্গলবার থেকে টানা তিনদিন ঢাকাসহ সারা দেশে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার জন্য সারা দেশের পরিবহন মালিক-শ্রমিকদেরকে অনুরোধ জানানো হয়।
বিএনপি-জামায়াত সমাবেশ ও হরতাল কর্মসূচির নামে দলীয় সন্ত্রাসীরা ঢাকাসহ সারা দেশে ১৩টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করেছে এবং শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করেছে। এছাড়া ঢাকায় অছিম পরিবহনের গাড়িতে থাকা নাঈম নামে একজন শ্রমিককেও পুড়িয়ে হত্যা করেছে। আন্দোলনের নামে গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ কোনোভাবেই বরদাস্ত করা যায় না।
পরিবহন নেতারা এ ধরনের ধ্বংসাত্মক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদেরকে জরুরিভাবে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানসহ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছে। একই সঙ্গে অবরোধের দিনগুলোতে গাড়ি চলাচলে যাতে কোনো প্রকার বাধাগ্রস্ত না হয় তার জন্য রাজধানী ঢাকাসহ জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ প্রশাসনকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআরটিসি) জনসংযোগ কর্মকর্তা হিটলার বল বলেন, বাস চলবে। সরকারি গাড়ি কোনো অবরোধ বা হরতালে বন্ধ থাকে না। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান। এছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবু রায়হান, ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্বাস উদ্দিন এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির অন্যান্য নেতারা।
তবে বিএনপি-জামায়াতের অবরোধে রাজধানীতে যেকোনো ধরনের সংঘাত এড়াতে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সদস্যরা। ইতোমধ্যে ঢাকাকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মাঠে রয়েছে গোয়েন্দা, র্যাব ও পুলিশের সদস্যরা। নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছেন বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরাও। ঢাকার প্রবেশপথ ও মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে নিরাপত্তা চৌকি।
র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছেন, বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধে যাতে কেউ নাশকতা করতে না পারে তাই কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে চৌকি বসিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। রাজধানীজুড়ে র্যাবের গোয়েন্দারা সর্তক দৃষ্টি রাখছে।