“বাংলাদেশ সরকারের উচিত ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা। চিরকাল পূর্ববঙ্গের মাটির জন্য হাহাকার করেছেন ঋত্বিক। এই মাটি থেকে তাঁকে শারীরিকভাবে উচ্ছেদ করা হলেও যেন সাংস্কৃতিকভাবে বা আত্মিকভাবে না করা হয়। এই বঙ্গের সঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের চিরকালই ছিল অন্তর বা আত্মার সম্পর্ক। বাড়িটি যেমন ছিল, ঠিক তেমনভাবেই যেন পুনরায় নির্মাণ করা হয়। আর তাঁর স্মৃতিকেই যেন টিকিয়ে রাখা হয় ঋত্বিক ঘটক জাদুঘর নির্মাণ করে, যে জাদুঘরে ঋত্বিক ঘটকের ছবি প্রদর্শিত হবে, ছবি নিয়ে গবেষণা হবে। ঋত্বিক তাঁর স্বপ্নের বাসভূমিতে রয়ে যাবেন। অমন বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারীর জন্য এটুকু করলে বাংলাদেশই ধন্য হবে। প্রতিভাবানকে যারা সম্মান করতে না জানে, তারা অশিক্ষিত এবং মূর্খ।”
বাংলা চলচ্চিত্র জগতের দিকপাল ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি ভেঙে ফেলা নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ সাব্যস্ত করেছেন বাংলাদেশের লেখক তসলিমা নাসরিনসহ সাহিত্যিক মহল।
ভাঙছে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ।
শিল্প-সংস্কৃতির চেয়ে সাইকেল গ্যারেজ তৈরির লক্ষ্য বিরাট হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের কাছে। ফলে শিল্পীর বাড়ির একটি অংশ ভেঙে তার ইট, সিমেন্ট, সুড়কি সরিয়ে ফেলা হয়েছে!
এ বেদনা রাখার স্থান কোথায়?
“পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের জন্য এ এক বিরাট লজ্জা। যাঁরা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, বেশির ভাগই দেশকে বুকের ভেতর লালন করেছেন, দেশের জন্য হাউমাউ করে কেঁদেছেন, কেঁদে কেঁদেই একসময় পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। কিশোরগঞ্জে দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়ি, ময়মনসিংহে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি, বিক্রমপুরে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি, বরিশালে জীবনানন্দ দাশ, ময়মনসিংহের গৌরিপুরে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বাড়িÑ এসবের কিছু কি অবশিষ্ট আছে? ঢাকায় জিন্দাবাহার লেনের কোন বাড়িতে পরিতোষ সেন বা ওয়ারীর কোন বাড়িতে অমর্ত্য সেন থাকতেন কোনও চিহ্ন আছে? নিশ্চয়ই নেই। যাদের সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি বলে চিহ্নিত করা হয়, তাদের কেন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে?”—তসলিমা নাসরিন।
রাজশাহী মহানগরীর মিঞাপাড়ায় ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি ভাঙার প্রতিবাদ জানিয়ে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দিয়েছে ১৩টি সাংস্কৃতিক সংগঠন।
এছাড়া কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক কুমার ঘটক এবং মৃণাল সেনের পৈতৃক ভিটা উদ্ধার এবং সংরক্ষণের দাবিতে শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে মানববন্ধন গড়ে তোলা হয় শাহবাগ, জাতীয় জাদুঘরের সামনে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড সিটির বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কার্যালয়ে গিয়ে কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এসময় প্রতিনিধি দলের নেতা সংস্কৃতিকর্মী গোপাল সান্যাল কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসার কাছে ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন। পরে কনসাল জেনারেলের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি স্মারকলিপি হস্তান্তর করা হয়।
রাজশাহী থিয়েটারের প্রাক্তন সভাপতি কামারউল্লাহ সরকার বলেন, ঋত্মিকের শেষ স্মৃতিচিহ্নটি ভেঙে ফেলছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এটা মেনে নেওয়া যায় না।
চলচ্চিত্র সংগঠক সাজ্জাক বকুল বলেন, “এটা নিন্দনীয়। দ্রুত নির্মাণকাজ বন্ধ করে ঋত্বিকের পৈতৃক ভিটা সংরক্ষণ করে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হোক। একই সঙ্গে এ ভিটায় ঋত্বিক ঘটক স্মৃতি জাদুঘরও গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছি আমরা।”
রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মুহম্মদ শরিফুল হক জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখে তাঁর ব্যবস্থা নেবেন।
উল্লেখ্য, সেনাপ্রধান থেকে দেশের ক্ষমতা দখল করে হুসেন মহম্মদ এরশাদ ১৯৮৯ সালে নামমাত্র মূল্যে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজকে বাড়িটি ইজারা দেন। সেটিই তারা এখন সম্পূর্ণ ব্যবহার করছে। বাড়িটির এক অংশে ইতিমধ্যে বহুতল ভবন করছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। যেসব কক্ষে ঋত্বিকরা থাকতেন সেসব কক্ষও ব্যবহার করছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তারই এক অংশ ভেঙে অস্থায়ী সাইকেল গ্যারেজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।