ঢাকা: বাংলাদেশে (bangladesh) বজ্রপাতে (lightning) বাড়ছে মৃত্যু সংখ্যা। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বায়ুমণ্ডলের আদ্রতা বেড়ে গেছে, হিমালয়ের পাদদেশে হাওর অঞ্চলগুলোতে উষ্ণতা ও পুঞ্জীভূত মেঘের আধিক্য, কিউমুলোনিম্বাস মেঘ বা ঝড়োপুঞ্জ মেঘ এবং পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে বজ্রপাত।
প্রতিবছর গড়ে বজ্রপাতে (lightning) মারা যাচ্ছেন তিনশ’রও বেশি মানুষ। শুধুমাত্র বৃহস্পতিবারই সিরাজগঞ্জের (sirajganj) উল্লাপাড়ায় বজ্রপাতে ৯ জন, ফরিদপুর সদর ও মধুখালী উপজেলায় ২ জন ও শেরপুরের নকলায় পৃথক দুই স্থানে বজ্রপাতে (lightning) ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের (sirajganj) উল্লাপাড়া উপজেলার পঞ্চকোশি ইউনিয়নের মাটিকোড়া এলাকায় বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বজ্রপাতে (lightning) নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ৮ জন।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মাটিকোড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তৌহিদুল আলম ফিরোজ। তিনি বলেন, কৃষি শ্রমিকরা মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাত হয়। বজ্রপাতে (lightning) শিশুসহ ৯ কৃষি শ্রমিক নিহত হয়েছেন।
নিহতরা হলেন-পঞ্চকোশী ইউনিয়নের মাটিকোড়া এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে শাহ আলম (৪০), একই গ্রামের বাহাদুর হোসেনের ছেলে আব্দুল কুদ্দুস (৬০), মোস্তফার মেয়ে রিতু খাতুন (১৪) উপজেলার সদরের শিবপুর গ্রামের ইমাম প্রামাণিকের ছেলে মোবাখর হোসেন (৪০), একই এলাকার মোকাম হোসেনের ছেলে মনাফ হোসেন (১৮), ছবের আলীর ছেলে শমসের আলী (৬০), তার ছেলে শাহিন (২১) ও বড় ভাই আফসার আলী (৬৩) এবং নুরনবীর মেয়ে জান্নাতি (১২)।
এ ঘটনায় আহত ৮ জনকে উল্লাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়েছে। সংবাদ পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজ্জ্বল হোসেন, থানা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মাটিকোড়া গ্রামের মাঠে বীজতলা থেকে ধানের চারা তুলছিলেন ১৩-১৪ জন কৃষি শ্রমিক। এ সময় বৃষ্টি ও বজ্রপাত শুরু হলে তারা সবাই মাঠের একটি শ্যালোমেশিনের ঘরে আশ্রয় নেন।
ওই শ্যালোমেশিনের ঘরে বজ্রপাত (lightning) হলে ঘটনাস্থলেই ৬ জন মারা যান। আহত ৮ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আরও ৩ জনকে মৃত ঘোষণা করেন।
উল্লাপাড়া মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম জানান, কয়েকজন শ্রমিক মাটিকোড়া এলাকার একটি জমিতে রোপা আমন ধানের চারা তুলছিলেন। এ সময় বৃষ্টি শুরু হয়। পরে বজ্রপাতের (lightning) ঘটনা ঘটে।
ঘটনাস্থলে ৬ জন নিহত হন। বাকিরা হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।অপরদিকে, ফরিদপুর (faridpur) সদর ও মধুখালী উপজেলায় বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু হয়েছে।
মধুখালী উপজেলার মথুরাপুর এবং সদর উপজেলার নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নে এ বজ্রপাত হয়। এছাড়া শেরপুরের নকলায় পৃথক দুই স্থানে বজ্রপাতে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
সূত্র জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত রুদ্র-রুষ্ট বিরূপ প্রকৃতি, উষ্ণতা বৃদ্ধি, উঁচু বৃক্ষ নিধনসহ বিবিধ কারণে প্রতি বছর বাড়ছে বজ্রপাত। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। বিশেষ করে, গ্রামের মানুষের কাছে বজ্রপাত এখন ভয়াবহ আতঙ্কের বিষয়।
এপ্রিল থেকে মে-জুন পর্যন্ত বজ্রপাতের মৌসুম। তবে এখন দেখা যায়, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। একজন মৃত্যুর সঙ্গে অন্তত ১০ জন আহত হয়ে থাকে বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বজ্রপাতে আহতরা স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়।
পৃথিবীতে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে (bangladesh)। বজ্রপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় বাংলাদেশে (bangldesh)। হাওর, বাঁওড় ও বিল এলাকার জেলাগুলোয় বজ্রপাতে মৃত্যু বেশি। ঝড়বৃষ্টির সময় খোলা মাঠ, জলাশয়, নৌকা ও পথঘাটে যারা চলাচল করে তারাই এর শিকার।
বাংলাদেশে (bangladesh) গত কয়েক বছরে বজ্রপাতের ঘটনা ১৫ শতাংশ বেড়েছে।প্রতি বছর গড়ে বজ্রপাতে ৩০০ জনের মৃত্যু হচ্ছে। গত এক যুগে এ সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি। চলতি জুন মাসের দেশের ১৩ জেলায় ৩১ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। গত বছর বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু অতীতের যে কোনো বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। ২০২১ সালে মারা গেছে ৩৬৩ জন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি সংগঠন ‘ডিজাস্টার ফোরাম’-এর তথ্য মতে, ১৯৮৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে ৬ হাজার ৭৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
২০১১ সাল থেকে চলতি বছর ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত বজ্রাপাতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ১৬২ জনের। এর মধ্যে ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন, ২০২০ সালে ২৩৬ জন এবং ২০২১ সালে ৩৬২ জন মারা গেছে বজ্রাঘাতে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কৃষিকাজের সময় ৭০ শতাংশ, সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ি ফেরার পথে এবং গোসল কিংবা মাছ শিকারের সময় ১৩ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রাঘাতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৭০ শতাংশই কৃষক।
তবে শহরের ভবনগুলোতে বজ্রপাত প্রতিরোধক দণ্ড থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম। বজ্রপাতের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক বছর হিসেবে ধরা হয় ২০১৬ সালকে। মৃত্যুর সংখ্যার কারণে তার আগের বছরের ১৭ মে বজ্রপাতকে ‘দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, প্রতি বছর এ সময় অনেক বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। এর কারণ সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে বায়ুদূষণ, বাতাসে কার্বনের পরিমাণ, লেডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া একটি বড় কারণ। যা কিনা বায়ুকে উত্তপ্ত রাখে।
কার্বন লেডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য আরো যেসব উপাদানগুলো মেঘ তৈরিতে সহায়ক, সেগুলো সক্রিয় থাকে এবং বজ্রপাত বেশি হয়। তাহলে বায়ুদূষণ কম হলে বজ্রপাত কম হবে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না।
তবে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, মোবাইল ফোন ব্যবহার বৃদ্ধি, অতিরিক্ত জনঘনত্ব ও বজ্রপাত মৌসুমে মাঠে-ঘাটে এবং জলাশয়ে মানুষের কর্মক্ষেত্রে সম্পৃক্ততা বেশি হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণার পর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নজরদারি বেড়েছে। এতে উঠে আসছে মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য। বজ্রপাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে অবকাঠামোগত প্রস্তুতির পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।
বুয়েটের জল ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৪০টি বজ্রপাত হয় বলে আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে।
বিশ্বে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। বিগত বছরগুলোয় অন্তত ১৫ শতাংশ বেড়েছে বজ্রপাত। প্রযুক্তির ব্যবহার করে বজ্রপাতে মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। বিশ্বের দেশে দেশে এই প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তড়িৎ ও ইলেকট্রিক্যাল কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম খান বলেন, একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগা ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়।
একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১০০ ভোল্ট বিদ্যুতই যথেষ্ট। তিনি আরও বলেন, বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে, মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পাঠ্যবইয়ে এর কারণ এবং এ থেকে রক্ষা পেতে করণীয় বিষয়ে পাঠদান জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু বাংলাদেশে। আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম (প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা) ও লাইটেনিং অ্যারেস্টর (বজ্রপাতনিরোধক) স্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে রক্ষার পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
কাজটি সরকারকেই করতে হবে। বেশি দরকার সচেতনতা। ওড়িশায় আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম বেশ কাজে লেগেছে বলে জানান তিনি।