ঢাকা: ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং Sitrang তাণ্ডব চালিয়ে বাংলাদেশে Bangladesh ১৩ জেলায় অন্তত ২১ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। গত সোমবার রাতে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের Sitrang প্রভাবে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে জোয়ারের জলে বালু উত্তোলনের ড্রেজার ডুবে ৮ শ্রমিক নিখোঁজ হয়েছেন।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের Sitrang আঘাতে দেশের ৪১৯টি ইউনিয়নে ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে Sitrang বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনে ব্যাঘাত ঘটার কারণে ৮০ লাখ গ্রাহক বর্তমানে বিদ্যুৎ সেবার বাইরে রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের Sitrang প্রভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমন ধান মাটিতে নুয়ে পড়েছে। ঘাম ঝরানো স্বপ্নের ফসলের এমন দৃশ্যে নির্বাক কৃষকরা। ধানের পাশাপাশি ভেসে গেছে পুকুর ও ঘেরের মাছ।
বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় শীতের আগাম সবজিও ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর সিত্রাং Sitrang যেভাবে আঘাত হানার আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেইভাবে ঘূণিঝড় সিত্রাং Sitrang আঘাত করেনি।
সুন্দরবন, সাতক্ষীরা, পটোয়াখালী হয়ে অগ্রভাগ আঘাত করে ত্রিপুরার দিকে চলে যায় সিত্রাং Sitrang। সমুদ্র বন্দরগুলোকে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত কমিয়ে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, দেশের উপকূলে তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং Sitrang। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭৫ কিলোমিটার বেগে এটি আঘাত হেনেছিল। এর প্রভাবে সারাদেশেই বৃষ্টি হয়েছে।
তবে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে বরিশাল ও মাদারীপুরে। ঘূর্ণিঝড়টির ব্যাপ্তি ছিল ৪০০ কিলোমিটার। অন্যান্য ঘূর্ণিঝড় থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম এটি। এটি যখন লঘুচাপ ছিল তখন থেকেই মেঘ ছাড়া শুরু করে।
সর্বশেষ দেশে স্থলভাগে এসে নিম্নচাপে পরিণত হয় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং Sitrang। এরপর এটি আরও এগিয়ে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল হয়ে শক্তি ক্ষয় করে ভারতের আসামের দিকে চলে যায়।
গত সোমবার সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন উপকূলীয় জেলায় গাছ ভেঙে সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর আসতে থাকে, বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে ও তার ছিঁড়ে বহু এলাকা অন্ধকারে ডুবে যায়।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং Sitrang আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কেটেছে উপকূলবাসীর। জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কায় বহু মানুষ নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। ভোর হতেই আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া মানুষেরা অনেকটা স্বস্তির সঙ্গে ফিরে গেছেন নিজ নিজ বাড়িতে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের Sitrang মধ্যে গাছ ভেঙে পড়ে, দেয়াল ধসে এবং পানিতে ডুবে দেশের ১৩ জেলায় অন্তত ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভারি বর্ষণ আর স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সঙ্গী করে গত সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম শুরু করে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’।
এর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই ঝড়ো হাওয়া আর ভারী বর্ষণ শুরু হয় উপকূলের জেলাগুলোতে। এর মধ্যে ভোলা সদর, দৌলতখান, লালমোহন ও চরফ্যাশনে মারা গেছেন ৪ জন।
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ঝড়ো বাতাসে ঘরের ওপর গাছ পড়ে প্রাণ গেছে এক দম্পতি এবং তাদের চার বছরের শিশুর। এছাড়া গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ও মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে ২ জন করে এবং নড়াইলের লোহাগড়া, বরগুনা সদর, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় এবং শরীয়তপুরের জাজিরায় ১ জন করে মারা গেছেন ঝড়ের মধ্যে গাছ ভেঙে পড়ে।
সিরাজগঞ্জের সদরে যমুনা নদীর একটি খালে নৌকা ডুবে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে। পটুয়াখালীতে ট্রলার ডুবে মারা গেছেন এক শ্রমিক। ঝড়ের সময় রাজধানীর হাজারীবাগেও দেয়াল ধসে এক রিকশাচালকের মৃত্যুর হয়েছে।
আর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জোয়ারের পানিতে ভেসে এসেছে এক শিশুর লাশ, যে জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল বলে পুলিশের ধারণা।
অপরদিকে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে জোয়ারের পানিতে বালু উত্তোলনের ড্রেজার ডুবে ৮ শ্রমিক নিখোঁজ হয়েছেন। গত সোমবার দিবাগতে রাতে এ ঘটনা ঘটে।
নিখোঁজ শ্রমিকরা হলেন-ড্রেজার চালক ইমাম মোল্লা (৩২), শাহীন মোল্লা (৩৮), মাহমুদ মোল্লা (৩২), আলামিন (২১), বশর (৪৫) ও তারেক। বাকী দুজনের নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি।
মীরসরাই থানার ওসি মো. কবির হোসেন বলেন, সিত্রাংয়ের প্রভাবে সাগরের জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ঝড়ো হাওয়ায় বালু উত্তোলনের ড্রেজার মেশিন সৈকত-২ পানিতে ভেসে গিয়ে ডুবে যায়।
এ সময় ড্রেজারে ৯ শ্রমিক অবস্থান করছিলেন। এদের মধ্যে ছালাম নামের একজন নিরাপদ স্থানে চলে গেলেও বাকিরা ড্রেজারে অবস্থান করছিলেন।
তিনি বলেন, বালু উত্তোলনকারী শ্রমিকরা দিন-রাত ড্রেজারে অবস্থান করে থাকেন। সেখানে খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি ঘুমেরও ব্যবস্থা ছিল। বিষয়টি কোস্ট গার্ডকে অবহিত করেছি। নিখোঁজদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিস ও কোস্ট গার্ড চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান জানান, যেভাবে সিত্রাং সৃষ্টি হয়েছিল, যেসব পূর্বাভাস ছিল, যেভাবে এর বিস্তৃতি ছিল এবং যেভাবে সরাসরি বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছিল-সবাই পূর্বাভাস দিয়েছিল যে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে।
কিন্তু আল্লাহর রহমতে সিত্রাং ঘূর্ণিঝড় হিসেবেই ছিল, এটা প্রবল বা অতিপ্রবল বা সুপার সাইক্লোন কোনটাতেই রূপ নেয়নি। বাতাসের গতিবেগ ৮০ কিলোমিটারের ওপরে যায়নি।
আমাদের যে ঘোষণা ছিল, সেই সময়ের অনেক আগেই অনেক দ্রুত গতিতে সিত্রাং উপকূল অতিক্রম করেছে। তিনি বলেন, আমাদের পূর্বাভাস ছিল, এটা বরগুনা ও পটুয়াখালীর ওপর দিয়ে যাবে।
কিন্তু পরে এটি আরও উত্তর-পূর্ব দিকে টার্ন নেওয়ার কারণে পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় সতর্কতার শুরু থেকেই আমাদের মাঠ প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করেছেন।
প্রায় ৬ হাজার ৯২৫ আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১০ লাখ মানুষকে আনা হয়েছিল জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করা ও শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় যেহেতু রাত ১০টার পরে অতিক্রম করেছে, আশ্রিত মানুষেরা মধ্যরাত থেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ত্যাগ করে বাড়িতে যাওয়া শুরু করেন।
সকাল হতে হতে সব আশ্রয়কেন্দ্র খালি হয়ে যায়। এ পর্যন্ত আমাদের ৪১৯টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সেখানে প্রায় ১০ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬ হাজার হেক্টর এবং এক হাজার মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ে বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে গেছে। উপকূলীয় জেলা ছাড়াও কুমিল্লা, গোপালগঞ্জ এমনকি ঢাকাতেও আঘাত হেনেছে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনে ব্যাঘাত ঘটার কারণে ৮০ লাখ গ্রাহক বর্তমানে বিদ্যুৎ সেবার বাইরে রয়েছে।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড-এর ৮০০-এর বেশি পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পিডিবিসহ সব মিলিয়ে প্রায় দেড়-দুই হাজার পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আশা করছি দ্রুত গ্রাহকের বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে পারব।
তবে ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রাজধানীর অন্তত দুই শতাধিক স্থানে গাছ ভেঙে সড়কে পড়েছে। এতে যান চলাচল বিঘ্নিত হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭৫ কিলোমিটার বেগে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত করে। গোপালগঞ্জে ৭৫ এবং চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কক্সবাজার, পটুয়াখালীতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল ৭৪ কিলোমিটার।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত বরিশালে বৃষ্টি হয়েছে ৩২৪ মিলিমিটার। ইতিহাসে বরিশালে এত বৃষ্টি আর কখনও হয়নি।
এর আগে ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর বরিশালে ২৬২ মিলিমিটার সর্বোচ্চ বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছিল। তবে মাদারীপুরে ৩১৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এটাকেও রেকর্ড বলছেন আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস।
তিনি বলেন, এর আগে ১৯৯৫ সালের ১২ জুন মাদারীপুরে সর্বোচ্চ ২৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে ঢাকায় ২৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তবে এর আগে ঢাকায় ৩৪০ মিলিমিটার বৃষ্টির রেকর্ড রয়েছে।