ঢাকা: বাংলাদেশে কক্সবাজারের টেকনাফে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র প্রভাবে ভারী বৃষ্টিতে বসতঘরের মাটির দেয়াল ধসে একই পরিবারের ৪ জনসহ সারাদেশে এখনও পর্যন্ত ৮ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
কক্সাবাজারে নিহতরা হলেন-টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজারের মরিচ্যাঘোনার পানিরছড়া এলাকার ফকির মোহাম্মদের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৫০), তার ছেলে শাহিদুল মোস্তফা (২০), মেয়ে নিলুফা ইয়াছমিন (১৫) ও সাদিয়া বেগম (১১)।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ঝড়ের সময় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে আবদুল ওহাব নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। ওহাব সন্দ্বীপের মগধরা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। মিরসরাইয়ে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে মারা গেছে ছিদরাতুল মুনতাহা নামের এক শিশু।
মুনতাহা মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাপাহাড়ের মহানগর এলাকার আনোয়ার হোসেনের মেয়ে।
গত শুক্রবার দুপুরে টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলা পরিষদের গেটের সামনে ঝোড়ো বাতাসে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে রাজ্জাক মিয়া (৪০) নামের এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়। রাজ্জাক মিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের মিরিকপুর গ্রামের কুসুম মিয়ার ছেলে।
তিনি বাসাইলের কোটিপতি মার্কেটে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। এ ছাড়া শরীয়তপুরে একজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে।
উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় হাজারের বেশি কাঁচা ঘরবাড়ির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি টানা বৃষ্টির কারণে উঠতি আমন ফসলও ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি অধিদপ্তর। গত শুক্রবার যেসব স্থানের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে তার মধ্যে বেশ কিছু এলাকায় বড় বড় গাছ ভেঙে ও উপড়ে পড়ে যান চলাচল ব্যাহত হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেললাইনে গাছ উপড়ে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম-নোয়াখালী-সিলেট তথা পূর্বাঞ্চলের ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল প্রায় দুই ঘণ্টা। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে উপকূলীয় অনেক জায়গা দুপুরের পর থেকে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিল। ফলে বিকালে দেশের মোট বিদ্যুতের চাহিদা অন্য দিনের তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসে।
অপরদিকে, ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র আঘাতে নোয়াখালীর হাতিয়া ও সুবর্ণচর উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উপড়ে পড়েছে অসংখ্য গাছপালা।
বিনষ্ট হয়েছে ক্ষেতের আমন ফসল ও শাকসবজি। বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে ও তার ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে পুরো জেলায় গত শুক্রবার থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত ৭০ ভাগ সংযোগে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এতে সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন জেলাবাসী।
ঘূর্ণিঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে আহত হয়েছেন মো. হানিফ নামের এক ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি। হাতিয়া উপজেলার চতলার ঘাটে ২৫০ বস্তা ধানসহ একটি ট্রলার ডুবে গেছে। এ ছাড়া ডুবে গেছে ঘাটে থাকা একটি ড্রেজার মেশিন।
ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র আঘাত শুরুর আগের রাত থেকেই জেলাজুড়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাত শুরু হয়। জেলা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার দুপুরে ঘূর্ণিঝড় নোয়াখালীতে আঘাত হানে। জেলা শহর মাইজদীতে ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ১২০ থেকে ১৪০ কিলোমিটার।
এতে শহরের পাঁচ রাস্তার মোড় এলাকায় একটি গাছ উপড়ে পড়ে বিদ্যুতের ১১ হাজার কেভিএ লাইন ছিঁড়ে যায়। ঝড়ের আঘাতে জেলার উপকূলীয় উপজেলা হাতিয়ার হরণী ও চানন্দিসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে ঘরবাড়ি, গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে কোথাও কোনও প্রাণহানির তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুল বাহার বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বিভিন্ন স্থানে গাছের ডালপালা পড়ে বিদ্যুৎ লাইনের তার ছিঁড়ে গেছে। জেলার ৯ উপজেলায় ১৭৯ টি বিদ্যুতের খুঁটি হেলে পড়ে।
শনিবার দুপুর পর্যন্ত ৩০ ভাগ সংযোগ সচল করা সম্ভব হয়েছে।জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড়ে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরূপণ করা যায়নি। মাঠপর্যায়ে কাজ চলছে। সব তথ্য পেলে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র কবলে পড়ে সমুদ্রে বিকল হয়ে যাওয়া একটি ট্রলারের ১৮ জেলেকে উদ্ধার করেছে কোস্ট গার্ড। গত শুক্রবার রাতে কক্সবাজার শহর থেকে ২১ নটিক্যাল মাইল দূরে বঙ্গোপসাগর থেকে জেলেদের উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের কক্সবাজার শহরের নুনিয়া ছড়া কোস্ট গার্ড বিসিজি স্টেশনে নিয়ে আসা হয়।
শনিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এতথ্য জানান কোস্টগার্ড পূর্ব জোন কক্সবাজার স্টেশন কমন্ডার লে. কমন্ডার মো. সালমান। লে. কমন্ডার সালমান জানান, ঘূর্ণিঝড় মিধিলি পরবর্তী বঙ্গোপসাগরে রাউন্ড দেওয়ার সময় ইঞ্জিন বিকল একটি মাছ ধরার ট্রলার ভাসমান অবস্থায় দেখতে পান কোস্ট গার্ড সদস্যরা। পরে ট্রলারসহ তাদের উদ্বার করে খাদ্য ও প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বিসিজি স্টেশনে নিয়ে আসা হয়।
উদ্ধারকৃত ট্রলার ও জেলেদের ট্রলার মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, গত ১৪ নভেম্বর ‘এফবি মায়ের দোয়া’ নামের একটি ফিশিং ট্রলার কক্সবাজারের টেকপাড়া এলাকার মাঝিরঘাট থেকে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে গভীর সমুদ্রে যায়। ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে সৃষ্ট দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কবলে ইঞ্জিন বিকল হয়ে ট্রলারটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সমুদ্রে ভাসতে থাকে।
এছাড়াও ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র আঘাতের পরদিন গতকাল শনিবারও দেশে ৩০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে দেশের প্রায় ২৮টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শনিবার এ তথ্য জানানো হয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ফেসবুক পেজে। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র প্রভাবে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ছিল ৬৭ লাখ গ্রাহক। ঝড়ের পরই মেরামত শুরু করে বিদ্যুৎ বিভাগ।
এক দিনে মেরামত শেষে ৩৭ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এখনো ৩০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজে জানানো হয়েছে, ২৮টি সমিতিতে এক হাজার ২০০টি গ্রুপে প্রায় সাত হাজার বিদ্যুৎ কর্মীরা লাইন পুনঃসংযোগের কাজ করছেন। অনেক এলাকায় ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
সন্ধ্যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত সব এলাকায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছে মন্ত্রণালয়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সব ৩৩ কেভি ফিডার ও ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র সচল রয়েছে। বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সাময়িক অসুবিধার জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়। গত শুক্রবার বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করে।
এ জন্য পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরে ৭ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ৬ নম্বর বিপৎসংকেত দেওয়া হয়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঢাকাসহ সারা দেশে বৃষ্টি হয়।
প্রসঙ্গত, পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগরে গত ১৪ নভেম্বর একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ার পর সেটি উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে সেই ঘূর্ণিবায়ুর চক্র ১৫ নভেম্বর নিম্নচাপে পরিণত হয়। তারপর বাঁক নিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে বৃহস্পতিবার পরিণত হয় গভীর নিম্নচাপে। পরে সেটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়।
ওই অবস্থায় মোংলা ও পায়রা বন্দরকে সাত নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দরকে ছয় নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়। গত শুক্রবার বেলা ১টার দিকে ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে মোংলা-পায়রা উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’।