এনআরসি আতঙ্ক কেড়ে নিল আরও একটি তাজা প্রাণ। এবার ঘটনার স্থান অসমের হাইলাকান্দি শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ড। এনআরসির সম্পূরক খসড়ায় নাম না থাকার জন্য শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন এই এলাকার বাসিন্দা সাবিত্রী রায় (৩৫) নামের এক মহিলা। বুধবার দুপুর ১টা নাগাত সংঘঠিত হয় এই করুণ ঘটনা।
গত ৩১ আগস্ট রাজ্যে প্রকাশ হয় রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা। এই চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ। বাদ পড়া মানুষরাই এখন ঘোর সংশয়ে। আশঙ্কা ও উদ্বেগের এই পরিস্থিতিতেই আত্মহত্যা করলেন এক মহিলা। তিনি হাইলাকান্দি জেলার ষ্টেশন রোডের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা দেবু রায়ের স্ত্রী সাবিত্রী রায় (৩৫)।
ঘটনার বিবরণে পরিবারের সদস্যরা জানান, সাবিত্রী রায়ের বাবার বাড়ী পশ্চিম ত্রিপুরার পূর্ব শিব নগর গ্রামে। সেখান থেকে বিয়ে হয়ে হাইলাকান্দি আসেন সাবিত্রী। এনআরসি নবীকরণ প্রকৃয়ায় লিট এ ডকুমেন্ট হিসাবে ১৯৬৬ সালের সেখানকার ভোটার লিষ্টের কপি জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরও নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি তালিকায়।
গত ৩১ তারিখ তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পরেই তালিকায় নিজের নাম নেই সেই কথা জানতে পেরে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন সাবিত্রী। পরিবারের লোক অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। গত চার দিন থেকে পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে কথা ও বন্ধ করে দেন সাবিত্রী।
পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রতিদিনের মতো বুধবারেও দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ স্নান করতে যান সাবিত্রী। কিন্তু এর কিছু সময় পড়ই চিৎকার শুনে সবাই ছুটে গিয়ে দেখেন বাথরুম থেকে ধোয়া বেরোচ্ছে। তখন তারা জোড় করে দরজা ভেঙে প্রায় ৯৫ শতাংশ অগ্নিদিগ্ধ অবস্থায় সাবিত্রীকে উদ্ধার করেন। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয় এস কে রায় অসামরিক হাস্পাতালে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা অগ্নিদগ্ধ সাবিত্রীকে শিলচর চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন। সেখানে বিকেল পাঁচটা নাগাদ মৃত্যু হয় সাবিত্রী রায়ের।
এদিকে ঘটনার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে যান বিজেপি শহর মণ্ডল সভাপতি মানব চক্রবর্তী সহ অন্যান্যরা। এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষিতে রীতিমতো কড়া অবস্থান নেবে বলে হুংকার দিয়ে হাইলাকান্দি শহর মণ্ডল কমিটির সভাপতি মানব চক্রবর্তী সহ অন্যান্য দলীয় কর্মীরা জানান, এনআরসি-তে নাম অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার জন্য আত্মঘাতী পথ বেছে নেওয়ার জন্য সরাসরি দায়ী জেলা প্রশাসন।
তারা বলেন, হাইলাকান্দি জেলায় সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের নাম কর্তন করেছে এনআরসি-র দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মীরা। আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া সাবিত্রী রায়ের নাম ছিল শহরের বিজ্ঞান মন্দির এনআরসি সেবা কেন্দ্রে। অভিযোগের আঙুল বিজ্ঞান মন্দিরে কর্মরত এনএসকে কর্মীদের উপর এনে মণ্ডল সভাপতি মানব চক্রবর্তী সহ অন্যান্যরা বলেন, ওই সেবা কেন্দ্রের কর্মীরা এক শ্রেণির লোকেদের দালাল হয়ে কাজ করেছেন। ফলে সাবিত্রী রায়ের মতো প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকের নাম অন্তর্ভুক্ত নয় নি।
বিজেপি-হাইলাকান্দি মণ্ডল সভাপতি মানব চক্রবর্তী অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, সাবিত্রী রায়ের মৃত্যুর দায়ভার হাইলাকান্দি জেলাশাসককে নিতে হবে। এই মৃত্যুর জবাবদিহি করতে হবে স্বয়ং জেলাশাসক ও এনআরসি-র জেলা ইনচার্জকে একথা জানিয়ে দিয়ে ক্ষুব্ধ মানববাবু কার নির্দেশে সাবিত্রী রায়ের নাম কর্তন করা হয়েছিল এর স্পষ্ট জবাব জানাতে হবে জেলাশাসককে। নতুবা ওই মহিলার মৃতদেহ সংকার করা হবে না। বিজেপি-র মণ্ডল সভাপতি মানব চক্রবর্তী সহ অন্যান্য জানিয়ে দিয়েছেন, এনআরসি-তে প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের নাম কর্তন হওয়ায় তারা চোখ বুজে বসে থাকবেন না।
অন্যদিকে, পুলিশ সুপার পবীন্দ্রকুমার নাথ জানিয়েছেন, সাবিত্রী রায়ের মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে ঘটনার খবর পেয়েই তিনি ডিএসপি (সদর)-কে ওই মহিলার বাড়িতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তবে মহিলার শরীর বেশি ঝলসে যাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হাইলাকান্দি থেকে পুলিশও পাঠানো হয় মেডিক্যালে। ওই সময় পুলিশ মহিলার জবাববন্দি নিতে গিয়ে তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন যে তিনি নিজে থেকেই এই পথ বেছে নিয়েছেন, এর জন্য পরিবারের কেউই দায়ী নন।
তবে পরিবারের লোকেরা সাবিত্রী রায়ের মৃত্যুর জন্য এনআরসি-তে নাম অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার কথাই পুলিশকে জানিয়েছেন। পুলিশ সুপার পবীন্দ্রকুমার নাথ জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ ঘটনার তদন্ত ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।