কলকাতা: দেখতে দেখতে চলে এল সরস্বতী পূজা। প্রস্তুতি নিচ্ছে বাঙালি। বিভিন্ন স্কুল, কলেজগুলো সাড়ম্বড়ে বাগদেবীর আরাধনার জন্যে সেজে উঠছে।
সরস্বতী পুজোর আনন্দ সবচেয়ে বেশি কচিকাঁচাদের।
সরস্বতী পুজো নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে।
সরস্বতী পূজার আগে কুল না খাওয়ার রীতি মূলত বাঙালি-অসমিয়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বেশি প্রচলিত।
এমন তো কোনো কথা নেই যে পূজোর আগে কুল খেয়ে ফেললে সরস্বতী মা রেগে যাবেন অথবা পরীক্ষায় আমার নম্বর কমিয়ে গোল্লা দিয়ে দেবেন! এদিকে এই রীতি কিন্তু কুসংস্কারও নয়। আসলে এটা বাঙালি সনাতন রীতির একটি অভিন্ন অংশ। লোকাচারও বটে।@ কিংবদন্তি অনুসারে, বৈদিক দর্শনবিদ্যা অর্জনের উদ্দেশ্যে এবং বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীকে তুষ্ট করার জন্য মহর্ষি ব্যাসদেব বদরিকাশ্রমে তপস্যা করছিলেন।
তপস্যা শুরুর আগে তাঁর তপস্যা স্থানের কাছে একটি কুলবীজ রেখে ব্যাসদেব শর্ত দিলেন যে, যখন এই কুলবীজ অংকুরিত হয়ে চারা,চারা থেকে গাছ,গাছের নতুন কুল হবে এবং সেই কুল পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পতিত হবে, সেইদিনই তাঁর তপস্যা পূর্ণ হবে বা সরস্বতী দেবী তুষ্ট হবেন।
ধীরে ধীরে কয়েক বছরে এই কুলবীজ অংকুরিত হয়ে চারা, চারা থেকে গাছ,গাছের নতুন কুল হলো এবং সেই কুল পেঁকে তা পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পতিত হলো। তখন তাঁর তপস্যা পূর্ণ হয়।
(কুল এর আরেক নাম বদ্রী,তপস্যার সাথে বদ্রী এর সম্পর্ক থাকায় বদ্রিনাথ নামে নারায়ণের মন্দির প্রতিষ্ঠিত হল এবং ঐ জায়গার নাম বদরিকাশ্রম নামে প্রচার হয়ে যায়।)
উল্লেখ্য যে, সে দিনটি ছিল শ্রীপঞ্চমীর দিন। সেদিন বেদমাতা সরস্বতীকে বদ্রী/কুল ফল নিবেদন করে অর্চনা করে তিনি “ব্রহ্মসূত্র” রচনা আরম্ভ করেন ও তাঁর সেবায় সরস্বতী দেবী তুষ্ট হয়েছিলেন।
সেই কাহিনীকে স্মরণে রেখেই পূজার দিনের আগে কুল খাওয়া উচিৎ নয় বলে বলা হয়। শ্রীপঞ্চমীর দিন সরস্বতী দেবীকে কুল নিবেদন করার পরেই কুল ভক্ষণ করা হয়। এই রীতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে আসছে।
# অন্যদিকে, সরস্বতী পূজা বসন্ত আগমনের সাথে সম্পর্কিত, তাই এর প্রতীক বাসন্তী রং। বাসন্তী রংয়ের আধপাকা কুল তাই এই ঋতুর ফলের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। কুল শীতকালীন ফল। মাঘ মাসে মা সরস্বতী পূজিত হন। মায়ের প্রথম পূজারী পড়ুয়ারা।
তাই তারা ভক্তিবশেই মা সরস্বতীকে নিবেদিত কুলই সর্বাগ্রে গ্রহণ করে। মা গ্রহণের পূর্বে তারা কুল খায় না। এটা আসলে মা সরস্বতীর প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ। কোনো কুসংস্কার নয়।
পুরাণমতে কুল সরস্বতীর প্রিয় ফল, এই বিবেচনায় কুল/ বরই সর্বপ্রথমে সরস্বতী দেবীকে অর্পনের মধ্য দিয়ে কুল খাওয়ার সূচনা করা হয়৷
যুগ যুগ ধরে বাঙালি নতুন ফসল ঘরে তুললে , তা গৃহদেবতাকে নিবেদন না করে গ্রহণ করে না।
বাঙালিদের সকল পার্বণই ঋতু ভিত্তিক হওয়ার জন্যে অনেক সময় দেখা যায় যে , সেই ঋতুভিত্তিক ফসলগুলো ওই নিৰ্দিষ্ট ঋতুতে পূজিত দেবতাকে নিবেদন করা হয়। যেমন : নবান্নে নতুন ধানের পিঠা পুলি লক্ষ্মী মাকে নৈবেদ্য হিসেবে দেয়া হয়।
তেমনি শীতকালের ফল কুলও সরস্বতী দেবীকে নিবেদনের আগে গ্রহণ করা হয় না।
আবার, বয়স্ক ব্যক্তিরা অকালে কাঁচা /কষযুক্ত কুল খেয়ে বাচ্চাদের শরীর খারাপ হতে পারে, এই উপলব্ধি থেকে পরিপক্ব হবার আগে কুল খেতে বারন করে দেন (এমনকি নিজেরাও খান না)।
তাই বলা যায়, সরস্বতী পূজার আগে কুল খাওয়া বা না খাওয়া কোনো শাস্ত্রগত নির্দেশ নয়, অথবা কোন কুসংস্কারও নয়। জ্ঞান অর্জনের একটি প্রক্রিয়া মাত্র।