এ এক অন্য রবিপ্রণাম। এ এক অপরিচিত রবি মাস। করোনায় কাঁপছে সারা বিশ্ব। মানুষ রুজি-রোজগার হারাবার পথে। কিন্তু ২৫শে বৈশাখ যে শিরায় শিরায় বইছে। এ অবস্থায় অনলাইনেই গান, নাচ, আবৃত্তি প্রভৃতি করে পোস্ট করছেন রবীন্দ্রপ্রেমীরা।
করোনার বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই জারি রেখেছে ভারত। এই কঠিন সময় রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের মনে সাহস যোগাচ্ছে! আমরা বিশ্বকবির ১৫৯তম জন্ম জয়ন্তীতে তাঁর অসম ভ্রমণ নিয়ে খানিকটা আলোচনা করবো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের কাছে কবিতা,ছবি, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, গান। বাংলা ও বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে সফলভাবে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভ্রমণপিপাসু। সে ভ্রমণে লাভ-লোকসানের অংক কষতেন না কখনো। মনের আনন্দই ছিল সেখানে মুখ্য।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি রাজ্য অসম ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় স্থানের মধ্যে একটি। কবিগুরু মোট তিনবার অসম ভ্রমণে এসেছেন। ১৯১৯, ১৯২৩ এবং ১৯২৭ সাল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সর্বপ্রথম অসম ভ্রমণে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন অসমের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সূর্যকুমার ভূঁইয়া। কবির আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে অধ্যাপক সূর্যকুমার কটন কলেজে (বর্তমান কটন বিশ্ববিদ্যালয়) ৪ই জুলাই ১৯১৮ সালে ইংরাজি বিভাগে যোগদান করেন।
বিশ্বকবি ছিলেন বটগাছের মতো চরিত্রসম্পন্ন একজন মানুষ। যিনি জীবনে বহু অকাল মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছেন, জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত ছিল অগুণতি। কিন্তু সারা জীবন অকুতোভয় হয়েই ছিলেন। মৃত্যু জীবনের অঙ্গ। ভিন্ন কিছু নয়। এই ছিল তাঁর মত।
“আমি ভয় করবো না , ভয় করবো না, দু-বেলা মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না”।
অধ্যাপক সূর্যকুমার ভূঁইয়া রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লেখার দেড় বছর পর অর্থাৎ ১৯১৯ সালের ১০ অক্টোবর প্রথম অসম (গুয়াহাটি) ভ্রমণে এলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর স্ত্রী কমলা।
সান্তাহার স্টেশনে এসে কবি এবং তাঁর সঙ্গীদল চেপে বসলেন শিলং মেলে। মাঝরাতে শুরু হয় মুষল বৃষ্টি। গুয়াহাটির নিকটবর্তী স্টেশন (আমিনগাঁয়ের নাম করেননি) নেমে ব্রহ্মপুত্রের ওপর খোজাজাহাজে চাপলেন। ওপারে পাণ্ডু স্টেশনে পৌঁছে ভেবেছিলেন মোটরগাড়িতে উঠবেন, কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের জল বৃদ্ধির জন্যে মোটরগাড়ি পাণ্ডুঘাটের কাছে আসতে অসমর্থ হল।
কবির ১০ অক্টোবর ছিল শিলং পৌছানোর কথা, কিন্তু বৃষ্টিতে পৌঁছালেন ১১ তারিখ। শিলঙে কবি এসে উঠলেন K.C DEY,CIE-র ১৮ কোঠার এক বাংলো বাড়িতে।বাড়ির নাম ‘BROOK SIDE’। আজকাল পুরনো সেই থাম সরিয়ে মেঘালয় সরকার নতুন প্রবেশদ্বার তৈরি করেছে।
এরপর ৩১ অক্টোবর তারিখে ‘BROOK SIDE’ বাংলো থেকে পুনরায় গুয়াহাটির পথে রওয়ানা দিলেন। আতিথ্য গ্রহণ করলেন তাঁর নাতজামাই অধ্যক্ষ জ্ঞানদাভিরাম বড়ুয়ার বাড়িতে। গুয়াহাটির দীঘলিপুখুরির পূর্ব দিকের এই বাড়িটিই তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের ‘আর্ল ল’ কলেজের প্রিন্সিপাল জ্ঞানদাভিরাম বরুয়ার বাসভবন ছিল। জ্ঞানদাভিরাম বড়ুয়া হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র অরুণেন্দ্রনাথের কন্যা লতিকা দেবীর স্বামী।
বাসভবনটি এখনো সশ্রদ্ধায় রক্ষিত। সেখানে কবিগুরু মোট ৩দিন অবস্থান করেছিলেন।
দীঘলি পুখুরির ধারে জ্ঞানদাভিরাম বড়ুয়ার বাসভবন। যেখানে কবি ৩ দিন আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। ছবিঃসাগরিকা দাস
পয়লা নভেম্বর পানবাজার জুবিলি পার্কে (বর্তমানে পাব্লিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জল শোধন কেন্দ্র) একটি সভার আয়োজন করা হয়। নেতৃত্বে ছিলেন আইন কলেজের প্রবীণ অধ্যাপক সত্যনাথ বরা।
অধ্যাপক জ্ঞানদাভিরাম বড়ুয়ার বাসগৃহে রবীন্দ্র স্মৃতি ফলক। ছবিঃ সাগরিকা দাস।
দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয় কার্জন হলে ২ নভেম্বর তারিখে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের গুয়াহাটি শাখা তখন কলা-সংস্কৃতি চর্চার এক ব্যস্ত কেন্দ্র। সভায় কটন কলেজের অধ্যাপক লক্ষীনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বেদশাস্ত্রী স্বরিচিত সংগীতে কবিকে অভর্থিত করা হয়।
সেদিনই দুপুরে ফের আর্ল ল কলেজে গুয়াহাটির মহিলারা বিশ্বকবিকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন স্বহস্তে বানানো এণ্ডি মুগার কাপড় দিয়ে।
বিকেল চারটায় কটন কলেজের এক সভায় কবি বক্তৃতা প্রদান করেন। সন্ধেবেলা পানবাজার ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের সামনে গুয়াহাটির ব্রাহ্মসমাজ দ্বারা আয়োজিত শিবনাথ শাস্ত্রীর স্মৃতিসভায় পৌরোহিত্য করেন রবীন্দ্রনাথ।
সভার বক্তৃতায় প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “মানুষের ভালোমন্দ দোষগুণ সব লইয়াই তাহাকে ভালোবাসিবার শক্তি খুব বড়ো শক্তি”।
আজ মহান আত্মার প্রয়াণ দিবসে ‘নর্থ ইস্ট নাও’ পরিবারের পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি থাকল গভীর শ্রদ্ধা এবং সশ্রদ্ধ প্রণাম।