নয়াদিল্লি: আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরিন কী লিখলেন এদিনটি নিয়ে বিশেষভাবে। তিনি তো বরাবরই নারী পুরুষের সমান অধিকার, নারী অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব। তাঁর লেখালেখি চলেছে সমানে।
নারী দিবসে তিনি লিখলেন:
“নারী দিবসে আমার আজ আলাদা করে কিছু বলার দরকার নেই। আমার প্রতিটি দিনই নারী দিবস। প্রতিটি দিনই অবহেলিত মানুষ দিবস, প্রতিটি দিনই অবহেলিত পশু দিবস, অবহেলিত শিশু দিবস, অবহেলিত প্রকৃতি দিবস, আমার প্রতিটি দিনই সত্যের জন্য, সুন্দরের জন্য জেগে ওঠার দিবস, আমার প্রতিটি দিনই অসত্য, অন্যায়, অত্যাচার, অনাচার, অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দিবস।
বছরের ৩৬৫ দিন পুরুষের । ১ দিন চেয়েছি আমাদের জন্য। মোটে ১টি দিন। ১ দিন নারীরা যেন পুরুষ দ্বারা নির্যাতিত না হয়, নিপীড়িত না হয়, অত্যাচারিত না হয়, ধর্ষিত না হয়,খুন না হয়।
অন্তত ১ টি দিন যেন নারীকে যৌন দাসি হতে না হয়, যৌন হেনস্থা হতে না হয়। অন্তত ১ টি দিন যেন নারীরা প্রাপ্য অধিকার পায়। ১ টি দিন যেন নারীকে নারী বলে অপমান করা না হয়। না সেটা সম্ভব হয় নি।
আমরা বলি বটে ১টি দিন আমাদের, নারীদের। ১টি দিন আমাদের দিয়েছে বলে পুরুষের কাছে আমদের কৃতজ্ঞতার সীমা নেই । আসলে, সত্যি হলো, ১টি দিনও আমাদের নয়। আমরা নিজেকে ফাঁকি দিয়ে চলেছি”।
“নারী দিবস জিনিসটি আমাকে কখনও আনন্দ দেয় না। আনন্দ দেয় না কারণ দিনটি আমার কাছে অত্যন্ত দুঃখের দিন। দুঃখের দিন কারণ প্রাপ্য অধিকার পাওয়ার জন্য আজও আমাদের চিৎকার করতে হচ্ছে।
সেই কতকাল আগে, সম্ভবত ১১১ বছর আগে, নির্যাতিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত ও অসম্মানিত না হওয়ার অধিকার চেয়েছিল নারী। সেই থেকে আজও বছর বছর এই দিনটিতে একই অধিকার চাওয়া হয়, চাওয়া হয় কারণ আজও নারীরা নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে নির্যাতিত, নিপীড়িত অত্যাচারিত ও অসম্মানিত।
আমরা ‘নারী দিবস’ পালন করছি, এর অর্থ আমরা নারীরা আজও বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। যেদিন সমানাধিকার পেয়ে যাব, সেদিন থেকে এই দিবসটির আর প্রয়োজন পড়বে না। সর্বান্তকরণে দিবসটির বিলুপ্তি চাই আমি”।
“মাঝে মাঝে ভুল করে ভাবি আমি বোধহয় একা নই। পৃথিবীতে হয়তো কেউ না কেউ আছে আমার আপন । নিজেকে নানা গল্প দিয়ে বোঝাই, আমি একা নই। নিজেই নিজের কাঁধে হাত রেখে, যেন অন্য কেউ হাত রেখেছে, নিজেই বলি, যেন অন্য কেউ বলছে, আছি।
এই আছি শব্দটি কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখে আমাকে। পরে অবশ্য টের পাই কেউ নেই চারদিকে। অতল সমুদ্রে একা ভাসছি আমি, হাতে আঁকড়ে আছি খড়কুটো। অথবা কোনও কূল কিনারহীন মরুভূমিতে একা বসে আছি। একাই তো ছিলাম দীর্ঘ দীর্ঘ বছর।
একাই হেঁটেছি পৃথিবীর পথে পথে। একাই হোঁচট খেয়েছি, একাই দাঁড়িয়েছি, একাই সাঁতরেছি, একাই চড়াই- উৎরাই পেরিয়েছি। ভেবেছিলাম এভাবেই নিজের ভেতরের আগুন আমাকে উত্তাপ দেবে, নিজের ভেতরের স্রোতস্বিনী আমাকে মায়াময়ী রাখবে। একাই আমৃত্যু কাটাবো আমার মতো। কাটাচ্ছিলাম।
কিন্তু আচমকা কেউ ধাক্কা দিল পেছন থেকে। হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। চেনা মুখগুলো আসছে, আঙুল স্পর্শ করে চলে যাচ্ছে। আমি শুধু প্রস্থানের শব্দ শুনছি। শুধু প্রস্থানের শব্দ। আর কোনও শব্দ নেই। যেন জ্যান্ত আমাকে কফিনে ঢুকিয়ে এক এক করে সকলে হারিয়ে যাচ্ছে। ‘একাই ছিলাম আমি, পুনরায় একলা হলাম।'”