চিনের উহান শহর থেকে সৃষ্ট সার্স করোনার ত্রাস সারা বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতে চলছে ২১ দিনের লক ডাউন।
এ মুহূর্তে ভারতে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা ১২’শ ছাড়িয়ে গেছে।
কোলাহলে পূর্ণ সারা দেশ, সারা বিশ্ব যেন আজ ঘুমিয়ে রয়েছে। তবুও আশা, আকাঙ্ক্ষা নিয়েই জীবনে বেঁচে থাকা!
এ মুহূর্তে কেমন আছেন নয়া দিল্লির বাড়িতে বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন?
মানববাদী লেখক, মানুষ তসলিমা চিরকাল ইতিবাচক চিন্তাধারার মানুষ। আজও তাই দেশের বিপর্যয়কালে, মানবজাতির বিপর্যয় কালেও চিন্তা করে চলেছেন, এই দুঃসময়য় দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। সবকিছু উলটে পালটে দিয়েছে ক্ষুদ্র ভাইরাস! কোনকিছুই হয়তো আর আগের মতো হবে না। হিংসা, দ্বেষ ভোলা উচিৎ মানবজাতির! মৃত্যু নিয়ে হাহাকার না করে বরং যে কটা দিন পাচ্ছি, তাকে কাজে লাগানো বুদ্ধিমানের কাজ।
তিনি বলছেন,
“মাঝে মাঝে মনে হয় আমি হয়তো ঘুমিয়ে আছি, পৃথিবীতে যা ঘটছে, তা ঘটছে আমার স্বপ্নের মধ্যে। ঘুম ভাংলেই দেখবো সবকিছু আগের মতোই আছে।
আমরা কি আবার আমাদের সেই আগের জীবন ফিরে পাবো? পাবো না। পৃথিবী কি আগের মতোই আবার…? না। কিছুই আর আগের মতো নেই। পৃথিবী বদলে গেছে, আমাদেরও বদলে দিয়েছে। কিন্তু এইভাবে লকডাউন করে কতদিন কাটাতে পারবো আমরা? বেশিদিন নয়। এইভাবে হাত ধুয়ে ধুয়ে, মাস্ক পরে পরে, মানুষকে কমপক্ষে সাড়ে তিন ফুট দূরে রেখে রেখে কতদিন ভাইরাসের নাগাল থেকে দূরে থাকতে পারবো? বেশিদিন নয়। করোনা আমাদের সবাইকেই একদিন না একদিন ধরবেই। কারো রেহাই নেই। করোনার কবল থেকে কেউ বেঁচে ফিরবে, কেউ ফিরবে না।
আমরা সবাই অপেক্ষা করছি ভ্যাক্সিনের। তাই না? বিজ্ঞানীরা বলেছেন ভাক্সিন আসতে ১৮ মাস লাগবে। আমরা কি ভেবে নিচ্ছি ১৮ মাস পর ৭০০ কোটি লোক ভ্যাক্সিন পেয়ে যাবো? মোটেও না। প্রডাকশানে সময় নেবে। ধরা যাক ৭০ লাখ ভ্যাক্সিন একদিনে তৈরি হলো। তাহলে ৭০০ কোটি লোকের জন্য ভ্যাক্সিন বানাতে ১০০০ দিন লাগবে। ১০০০ দিন মানে কিন্তু প্রায় ৩ বছর। তো এখন থেকে ১৮ মাসকে যোগ করে সেটি দাঁড়ায় ৪ বছর। যতদিন না ভ্যাক্সিন পাচ্ছি, আমরা কেউ কি ভাইরাসকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারবো? আমার মনে হয় না। অনেক বিজ্ঞানীও মনে করেন না। তাঁরা মনে করেন পৃথিবীর সবাই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবে, কেউ কেউ মনে করেন, সবাই না হলেও ৮০ ভাগ মানুষ আক্রান্ত হবে।
সোজা কথা মৃত্যু আসছে। আমরা যারা রিস্ক গ্রুপের তাদের কাছে খুব দ্রুত আসছে। মৃত্যু নিয়ে হাহাকার না করে বরং যে কটা দিন পাচ্ছি, তাকে কাজে লাগানো বুদ্ধিমানের কাজ। প্রতিটি দিনকে যেন ভেবে নিই এ আমার শেষ দিন।”
“আপাতত ভ্যাক্সিন ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই। ভ্যাক্সিন বের হতে নাকি ১৮ মাস। ১৮ মাস কী করবো, ঘরে বসে থাকবো? আমার মতো রিস্ক ক্যাটাগরির লোক ভ্যাক্সিন অবধি টিকে থাকতে পারে কিনা সন্দেহ। ভাইরাস তো শুনেছি থেকেই যাবে পৃথিবীতে। জানিনা কী হবে, কেউ কি সত্যিই জানে? যাঁরা গবেষক, তাঁরাও হয়তো সঠিক জানেন না, শুধু অনুমান করছেন।
এই পৃথিবীতে মানুষ তো আর শুধু আমরাই ছিলাম না, আরও নানান জাতের মানুষ ছিল। সব কটাকে মেরে ফেলেছি আমরা। কী ভয় কী ভয়! আমরা ছাড়া অন্য কেউ রাজত্ব করতে পারবে না। নিজেদের এক সময় নাম দিলাম ‘সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব’। শিম্পাঞ্জির বংশধরেরা নাকি শ্রেষ্ঠ জীব! খুনোখুনি আর বর্বরতা করে শ্রেষ্ঠ সেজেছি। জীব জন্তু পশু পাখিকে মেরে ধরে সর্বনাশ করেছি। এর লোম দিয়ে ওভার কোট বানাবো, ওর চামড়া দিয়ে হ্যান্ডব্যাগ বানাবো, এর থাবা দিয়ে ছাইদানি বানাবো, ওর দাঁত দিয়ে গয়না বানাবো, আমাদের শখের শেষ নেই। এই পৃথিবী যে শুধু আমাদের নয়, ওদেরও— যেন ভুলেই গিয়েছিলাম।
এখন ওই ‘ইতর’ পশু পাখিগুলোই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবগুলোকে একঘরে করে রেখেছে, এতটাই ওদের শক্তি। আর আমরা জানিইনা ভবিষ্যত বলতে আমাদের কিছু আছে কি না।”